“শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড ” – অতি পুরাতন কিন্তু খাঁটি কথা। সৃষ্টির ঊষালগ্ন হতেই শিক্ষার গুরুত্ব অনুভুত হয়েছে অনুক্ষণ। একবিংশ শতাব্দীর এ বিজ্ঞান বিভাসিত যুগে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। শিক্ষা মনের অন্ধকার দূর করে, জাতিকে পৌঁছে দেয় উন্নতির স্বর্ণশিখরে। মূলত একটি দেশের শিল্প, সাহিত্য, পেশা, সভ্যতা সবকিছু দাঁড়িয়ে থাকে শিক্ষা নামক সোপানের উপর। সঙ্গত কারণেই বলা হয় – পৃথিবীতে যে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি তত উন্নত। শিক্ষার মাধ্যমেই সমাজ তার সমগ্র উন্নতি এবং প্রবৃদ্ধি সাধন করতে পারে। কোন জাতিই শিক্ষা ছাড়া তাদের ভাগ্যোন্নয়ন করতে পারেনি; ভবিষ্যতেও পারবেনা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা সমপ্রসারণশীল কিন্তু গুণগতমান সন্তোষজনক নয়। শিক্ষার ব্যবস্থাপনা ও মান, দু’টিই এখন সংকটের মুখে। শিক্ষার মান ক্রমান্বয়ে অবনতির দিকে ধাবিত হওয়ায় শিক্ষা সম্পর্কে জনসাধারণের আগ্রহ কমে যাচ্ছে এবং জাতীয় জীবনে ব্যাপক অবক্ষয় নেমে আসছে। অভিজ্ঞ ও মেধা সম্পন্ন শিক্ষকের অভাব, শিক্ষকদের আদর্শচ্যুতি, শিক্ষাঙ্গনে অপরাজনীতি, সন্ত্রাস, ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষা পদ্ধতি, প্রতিষ্ঠানভিত্তিক পাসের বাধ্যবাধকতা, শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতির বেহাল অবস্থা ইত্যাদি কারণে শিক্ষা ব্যবস্থায় নেমেছে ধ্বস।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘদিন পরও আজ পর্যন্ত এখানে আদর্শ ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়নি। বাংলাদেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় নাগরিকদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবার ব্যবস্থা নেই। এ অবস্থা চলে আসছে আরো আগে থেকে। মুসলিম শাসনামলে ভারত উপমহাদেশে চালু ছিলো ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা। সে শিক্ষা ব্যবস্থায় তৈরি হতো আদর্শ নাগরিক, আদর্শ মুসলিম এবং দেশ পরিচালনার যোগ্যাসম্পন্ন দক্ষ নেতৃত্ব ও জনশক্তি।
কিন্তু ১৭৫৭ সাল থেকে যখন ইংরেজরা ভারতবশর্ষ দখল করে নিতে থাকে, তখন থেকে তারা এ দেশে এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার ব্যবস্থা করে, যে শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার ব্যবস্থা থেকে তারা এ দেশে এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার ব্যবস্থা করে, যে শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা লাভকারীরা তাদের মানসিক গোলাম হিসেবে তৈরি হবে। তাদের খাদেম ও সেবক হয়ে কাজ করবে এবং মুসলমানের ঘরে জন্ম নিলেও সত্যিকার খাদেম ও সেবক হয়ে কাজ করবে এবং মুসলমানের ঘরে জন্ম নিলেও সত্যিকার মুসলিম হয়ে গড়ে উঠবেনা। শেষ পর্যন্ত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাহীন ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা তার শৌর্যবীর্য হারিয়ে স্তিমিত হয়ে পড়ে এবং কার্যকারিতা হারয়ে ফেলে। অপরদিকে বৃটিশদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা ব্যবস্থা জমে উঠে। চাকুরি বাকরিসহ বস্তুগত জীবন ধারণ ও জীবন যাপনের জন্যে তখন এই শিক্ষা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়ে।
দ্বিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা
সেই থেকে এদেশে চালু হয় দ্বিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা। অর্থ্যাৎ দুই ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা। একটি হলো বৃটিশদের বস্তুবাদী দর্শনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা। আর অপরটি হলো পূর্ব থেকে চলে আসা মুসলামানদের ধর্মীয় তথা মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ধীরে ধীরে তার উপযোগিতা হারিয়ে ফেলে।
এ সময় মুসলমানরা রাষ্ট্র ও ক্ষমতা হারিয়ে জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে সম্পর্কহীন হয়ে পড়ার কারণেই তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাও ধীরে ধীরে সেকেলে হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের পরিচালিত মাদ্রাসাগুলো শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত হয়। সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্য লোক তৈরি করবার উপযুক্ততা হারিয়ে ফেলে।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতার সময় ভারত বিভক্ত হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহ নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান রাষ্ট্র। আর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহ নিয়ে গঠিত হয় ভারত।
মুসলমানরা স্বাধীন পৃথক রাষ্ট্র দাবি করেছিল ইসলাম অনুযায়ী দেশ পরিচালনার জন্যে। তাদের আদর্শিক ঐতিহ্য ও শিক্ষা সংস্কৃতি চালু করবার জন্যে। কিন্তু যারা পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় আরোহণ করে, তারা মুসলামনদের এই প্রাণের দাবির সাথে গাদ্দারি করে। তারা পাকিস্তানে কিছুতেই ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ও চালু করেনি। ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেনি। তারা ইংরেজদের চালু করেনি। ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেনি। তারা ইংরেজদের চালু করে যাওয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা সবই হুবহু বহাল রাখে। কিছু সংস্কার সংশোধন করলেও ইসলামের পক্ষে তেমন কিছুই করেনি। কেবল মুসলমান জনগণের প্রবল চাপের মুখে বাধ্য হয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান নামের সাইন বোর্ডটি গ্রহণ করে। ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা করেননি। অতপর চব্বিশ বছরের মাথায় পাকিস্তান ভেংগে যায়। পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যায় পাকিস্তান হিসেবে।
একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা
স্বাধীন বাংলাদেশেরও চব্বিশ বছর বিগত হলো। আদর্শ ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা এখানে চালু হয়নি। জনগণের প্রাণের দাবি ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণীত ও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
১৯৭১-র স্বাধীনতার পর কয়েকবারই জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের চেষ্টা করা হয়েছে। ডঃ কুদরাত-এ-খুদা, মজীদ খান ও প্রফেসর মফিজ উদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। প্রথম কমিশনটি ছিলো ডঃ কুদরাত-এ-খুদা কমিশন। এ কমিশনের রিপোর্টের উপর বিগত ৪ ফেব্রুয়ারি ৯৭ তারিখে ঢাকাস্থ হোটেল সুন্দরবনে একটি আলোচনা হয়েছিল যে,
আপনারা জানেন, ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই তৎকালীন সরকার কর্তৃক ড:কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। একই সালের ২৪ সেপ্টেম্বরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এ কমিশনের উদ্বোধন করেন। কমিশন সদস্যগণ ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে ভারত সরকার কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে ভারত সফর করেন। এক মাসব্যাপী সেখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। অতপর কমিশন সরকারি প্রস্তাবের নির্দেশনানুযায়ী ১৯৭৩ সালের ৮জুন প্রধানমন্ত্রীর নিকট অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট পেশ করেন। প্রধানমন্ত্রী রিপোর্ট গ্রহণ করে সন্তোষ প্রকাশ করেন। (বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ভূমিকা-)
আপনারা একথাও অবগত আছেন, ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরির্তনের পর উক্ত শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট আর বাস্তবায়িত হয়নি। এ বিষয়টিও নিশ্চয়ই আপনাদের দৃষ্টি এড়ায়নি যে, বর্তমান সরকার ইতোমধ্যেই উক্ত কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কিমিশনই রিপোর্টকে গণমুখী ও যোগপযোগী করে একটি বাস্তবভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়নে উদ্দেশ্যে অধ্যাপক শামসুল হকের নেতৃত্বে ৫৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটিও গঠন করেছে।
একথাতো তো কোন প্রকার সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশের জন্যে অবশ্যি একটি যুগোপযোগী বাস্তবভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রয়োজন। কিন্তু যুগোপযোগী এবং বাস্তবভিত্তিক কথা দুটি আপেক্ষিক। এ দুটি কথাই দৃষ্টিভংগি দ্বারা বিবেচিত ও প্রভাবিত হয়ে থাকে। যেমন, কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টকেও গণমুখী, যুগোপযোগী এবং বাস্তবভিত্তিক শিক্ষা রিপোর্ট বলা হয়েছিল।
এ রিপোর্টের ভূমিকায় বলা হয়: আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমাদের সুপারিশসমূহ বাস্তাবায়িত হলে শিক্ষা ক্ষেত্রের এ অবঞ্চিত পরিস্থিতির অবসান ঘটবে এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে নব দিগন্তের সূচনা হবে।
নবদিগন্ত সূচনাকারী সেসব সুপারিশ কি? উক্ত শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট থেকে আমি কয়েকটি সুপারিশ আপনাদের সামনে উল্লেখ করছি:
১. কাজেই দেশের কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্তসহ সকল শ্রেণীর জনগণের জীবনে নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনের উপলব্ধি জাগানো, নানাবিধ সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা অর্জন এবং তাদের মাঝে বাঞ্চিত নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজ সৃষ্টির প্রেরণা সঞ্চারই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান দায়িত্ব ও লক্ষ্য। (অধ্যায়: ১:১)
২. আমাদের শিক্ষার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবোধ শিক্ষার্থীর চিত্তে জাগ্রত ও বিকশিত করে তুলতে হবে এবং তার বাস্তব জীবনে যেন এর সম্যক প্রতিফলন ঘটে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। (অধ্যয় : ১: ২)
৩. সাম্যবাদী গণতান্ত্রিক সমাজ সৃষ্টির সকল নাগরিকদের ….শিক্ষা সুনিশ্চিত করতে হবে। (অধ্যায় : ১:২)
৪. নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজে স্বাধীন চিন্তা, সৃজনশীল, সংগঠন ক্ষমতা ও নেতৃত্বের গুনাবলী বিকাশের উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। (অধ্যায়: ১:৯)
৫. প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বাংলাদেশেকে গভীরভাবে ভালবাসতে হবে এবং বাঙালী জাতীয়তাবাদ আদর্শের সম্যক উপলব্ধি অর্জন করতে হবে। (অধ্যায় ২:৩)
৬. সমগ্র দেশে সরকারী ব্যয়ে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত একই মৌলিক পাঠ্যসূচি ভিত্তিক এবং অভিন্ন এবং অভিন্ন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। (অধ্যায় ৭:৯)। (অর্থ্যাৎ মাদ্রাসা শিক্ষা থাকবেনা)।
৭. প্রাথমিক শিক্ষার পঠিতব্র বিষয় : সাপ্তাহিক পিরিয়ড:
প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণীর পর্যন্ত ধর্ম শিক্ষা থাকবেনা। ৬ষ্ট, ৭ম ও ৮ম শ্রেণীতে সপ্তাহে ধর্ম শিক্ষার ২টি করে পিরিয়ড থাকবে। (অধ্যায় ৭:১০)
৮. মাধ্যমিক শিক্ষা স্তর হবে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত। এ স্তরের শিক্ষার্থীদের বয়সের প্রেক্ষিতে ধর্ম শিক্ষার একই শিক্ষা পরিবেশ শিক্ষাদানের সুযোগ সৃষ্টি শিক্ষা মনোবিজ্ঞান সম্মত। (অধ্যায় : ৭:১০) । অর্থ্যাৎ সহশিক্ষা।
৯. নবম শ্রেণী হতে শিক্ষা কার্যক্রম মূলত দ্বিধাবিভক্ত হবে: (ক) বৃত্তিমূরক শিক্ষা ও (খ) সাধারণ শিক্ষা। (অধ্যায় ৮:৫)। (ধর্মীয় শিক্ষা থাকবেনা)।
১০. মাদ্রসা শিক্ষা পদ্ধতি অনেকটা একদেশদর্শী। কেননা সকল শিক্ষার্থীকেই ইসলাম সম্পর্কে বিশেষ শিক্ষা প্রদান মাদ্রাসার লক্ষ্য। (অধ্যায়: ১১:২)
১১. বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মাদ্রাসা শিক্ষার আমূল সংস্কার ও যুগোপযোগী পূর্ণগঠনের প্রয়োজন। আমাদের সুপারিশ হচ্ছে দেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রিপোর্টের সপ্তম আধ্যায় বর্ণিত একই প্রাথমিক শিক্ষাক্রম (১ম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত) প্রবর্তিত হবে। (অধ্যায় ১১:৩)। অর্থ্যাৎ মাদ্রাসা থাকবেনা।
এ শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাস্তব ও কর্মমূখী করার জন্যে অনেকগুলো প্রস্তাবই আছে। তবে সেই সাথে শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতির ঈমান আকীদা, ধ্যান ধারণা, দৃষ্টি ভংগি ও ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত করার একটা পরিকল্পনাও পরিলক্ষিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, জাতির ভবিষ্যত প্রজন্মকে ইসলামী আদর্শের বিপরীত বিশেষ ধ্যান ধারণা ও দৃষ্টিভংগিতে গড়ে তোলার সুস্পষ্ট সুপারিশ এই রিপোর্ট রয়েছে। সুতরাং এ রিপোর্টকে কতটা গণমুখী ও বাস্তব ভিত্তিক বলা যায়?
বর্তমান সরকার উক্ত কমিশনের সুপারিশমালাকে বাস্তবভিত্তিকে করে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্যে যে কমিটি গঠন করেছে, সে কমিটি কি কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের সুপারিশমালায় সন্নিবেশিত লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভংগি পাল্টাবে? জাতির ঈমান আকীদা,দৃষ্টিভংগি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা কি তারা চিন্তা করবে? তারা কতি পারবে ইসলামী আদর্শভিত্তিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে? দীনি শিক্ষার অস্তিত্ব বজায় রাখতে?
সরকার কমিটি সদস্যদের তালিকা প্রকাশ করার পর জাতি হতাশ হয়েছে। ইতোমধ্যেই এ কমিটির ব্যাপারে পত্র-পত্রিকায় বিরুপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ কমিটি জাতির প্রত্যাশিত শিক্ষানীতি প্রণয়ন করবে বলে সচেতন মহল মনে করতে পারেছনা। ফলে ইসলামী শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষার অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়েছে।
সরকার ড: কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টকে বাস্তবভিত্তিক ও যুগোপযোগী করার জন্য যে কমিটি গঠন করেছে (জানুয়ারি ৯৭তে), সে কমিটিকে প্রস্তাব ও সুপারিশমালা প্রদানের জন্যে সেন্টার ফর পলিসি স্টাডিজ ২১
১. দ্রষ্টব্য : জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নে প্রস্তাব ও সুপারিশমালা গ্রন্থ প্রকাশক: সেন্টার ফর পলিসি স্টাডিজ, জুন ১৯৯৭।
মার্চ ৯৭ তারিখে ন্যাম এ এক সেমিনার কাম ওয়ার্কশপের বলা হয়েছিল যে,
নীতিহীন শিক্ষা ব্যবস্থা জাতিকে বিভ্রান্ত করে। শিক্ষা অবশ্যই এমন হতে হবে, যে, শিক্ষা মানুষকে স্রষ্টামুখী করে এবং সাথে সাথে জীবন ও জগতকে সঠিক নীতি ও দক্ষতার সাথে পরিচালিত করার উপযুক্ত করে গড়ে তোলে। তাই শিক্ষানীতি আমাদের লাগবেই। আমাদের উপযুক্ত করে গড়ে তোলে। তাই শিক্ষানীতি আমাদের লাগবেই। আমাদের শিক্ষানীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে একথা সুস্পষ্ট করে বলে দিতে হবে যে, আমরা আমাদের সন্তানদের মধ্যে কোন দৃষ্টিভংগি, ধ্যান-ধারণা, আকিদা, কোন ঐতিহ্য চেতনা এবং কিসের প্রেরণা সৃষ্টি করতে চাই? অর্থ্যাৎ আমরা আমাদের শিক্ষা দর্শনকে কোন ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে চাই? একথাতো পরিষ্কার, মানুষের দৃষ্টিভংগি ও নৈতিক চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে যদি ধর্মীয় বিশ্বাসকে ভিত্তি বানানো না হয়, তাহলে Stanly Hull এর কথাই যথার্থ। তিনি বলেছিলেন, তিনটি R অর্থ্যাৎ Reading, Writing এবং Arithmetic এর সাথে যদি ৪র্থ R মানে Rascal-ই পাবেন। অর্থ্যাৎ সেক্ষেত্রে শিক্ষাথীর্রা Rascal হতে বাধ্য। বিশ্বের অবশ্যি এক আল্লাহমূখী হতে হবে। তিনি এবং তাঁর বিধানই মানুষের সত্যিকার কল্যাণ সাধন করতে পারে। মানুষের সত্তাকে তিনিই সোনালি চুলকে নয়, আমার সত্তাকে ভালোবাসবে প্রেমিকার এ দাবির প্রেক্ষিতে মহাকবি W.B.Yeats বলেছিলেন:
I heard an old religious man
But yester night declare
That he had found & text to prove
That only God, my dear,
Could love you for your self alone
And not for your yellow hair.
হ্যাঁ, কেবল আল্লাহই মানুষকে সত্যিকার ভালোবাসেন। তাই কেবল তাঁর বিধানই মানুষের ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণের গ্যারান্টি। মানব কল্যাণের শিক্ষা ব্যবস্থা কেবল আল্লাহ বিধানের ভিত্তিতেই গড়ে উঠতে পারে।অপরদিকে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা হতে হবে এতোটা উন্নত একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করেছে। এ প্রতিবেদনের শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বল হয়েছে:
১. ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে নৈতিক, মানবিক,ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠাকল্পে শিক্ষার্থীদের মননে, কর্মে ও ব্যবহারিক জীবনে উদ্দীপনা সৃষ্টি করা।
২. বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভোমত্ব ও অখন্ডতা রক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীকে সচেতন করা।
৩. মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রণিত করে তোলা এবং তাদের চিন্তা চেতনায় দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবোধ এবং চরিত্র সুনাগরিকের গুলাবলির বিকাশ ঘটানো।
৪. দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থায় পরিবর্তন আনার জন্য শিক্ষাকে প্রয়োগমুখী, উৎপাদনক্ষম, সৃজনশীল করে তোলে এবং শিক্ষার্থীদের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন, দায়িত্ববান ও কর্তব্যপরায়ণ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা।
৫. কায়িক শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আগ্রহী করে তোলা এবং শিক্ষার স্তর নির্বিশেষে আত্মকর্ম সংস্থানে নিয়োজিত হওয়ার জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষার দক্ষতা অর্জনে সমর্থ করা।
৬. বিশ্বভ্রাতত্ব, অসাম্প্রদায়িকতা, সৌহার্দ্য ও মানুষে মানুষে সহমর্মিতাবোধ গড়ে তোলা এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলা।
৭. গণতান্ত্রিক চেতনাবোধের বিকাশের জন্য পারষ্পরিক মতাদর্শের প্রতি সহনশীল হওয়া এবং জীবনমুখী, বস্তুনিষ্ঠ ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশে সহায়তা করা।
৮. শিক্ষার প্রত্যেক স্তরে পূর্ববর্তী স্তরে অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতাও দৃষ্টিভঙ্গির ভিত দৃঢ় করা ও এগুলো সম্প্রসারণে সহায়তা করা এবং নবতর জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে শিক্ষার্থীদের সমর্থ করা।
৯. জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতির ধারা ও নৈতিক মূল্যবোধ বিকশিত করে বংশ পরস্পরায় হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা।
১০. দেশর জনগোষ্ঠীকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা।
১১. বৈষম্যহীন সমাজ সৃষ্টির লক্ষ্যে মেধা ও প্রবণতা অনুযায়ী শিক্ষালাভের সমান সুযোগ-সুবিধা অবারিত করা।
১২. শিক্ষার জাতি, ধর্ম, গোত্র নির্বিশেষে নারী পুরুষ বৈষম্য (Gender bias) দূর করা।
১৩. শিক্ষার সর্বস্তরে সাংবিধানিক নিশ্চয়তার প্রতিফলন ঘটানো।
১৪. পরিবেশ-সচেতনতা সৃষ্টি করা। ৩
৩. পরিবেশ : জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি ১৯৯৭, পৃষ্ঠা: ৯,৪০।
এখানে ২নং পয়েন্ট সুস্পষ্ট ও অকাট্য কথা বলে দেয়ার পর ৩ নং পয়েন্ট মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি, তা উহ্য ও অস্পষ্ট রেখে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। তাছাড়া ৬,৭ ও ৯ নং পয়েন্টসমূহ খুবই বিভ্রান্তিকর। এছাড়া এ প্রতিবেদনের ভেতরেও মাঝে মাঝে বেশ বিভ্রান্তিকর সুপারিশ করা হয়েছে।
এযাবত যতোগুলো শিক্ষা কমিশন রিপোর্টেই প্রকাশ হয়েছে, তার কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি। তবে শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিকে বিভিন্ন সময় সংস্কার করা হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সময় কিছু কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তবে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ইসলাম, বিজ্ঞান,প্রযুক্তি ও আধুনিক দৃষ্টিভংগির সমন্বয়ে এখনো ঢেলে সাজানো হয়নি।
আমাদের দেশে এখনো মূলত সেই ইংরেজ আমল থেকে চলে আসা দুই ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে। একটি হলো ট্রেডিশনাল মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা আর অপরটি ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত বস্তুবাদী শিক্ষা ব্যবস্থা। একটি আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানে বিবর্জিত আর অপরটি ইসলামী আদর্শ বিবর্জিত। একটি জাতির লোকেরা দুই ধারায় শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে আরেক ধারার শিক্ষার্থীরা সুধারণা পোষণ করেনা। আদর্শ মুসলিম জাতি গঠনের জন্যে এর কোনো ধারাই এখন আর উপযুক্ত নয়। উভয় ধারার শিক্ষা ব্যবস্থাকেই আমাদের বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার।
আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করার পরও অত্যন্ত সাধারন অনেক বিষয়ে কোনরকম জ্ঞ্যান অর্জন করা আমাদের হয় না। তাহলে আমরা কোথা হতে এসব বিষয় শিখব ? সামাজিক ব্যক্তিগত , পারিবারিক ইত্যাদি সমস্যাগুলো এ জন্যই তৈরি হয় এবং প্রতিদিন মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা দেখি কিভাবে আমাদের দেশ সামাজিক মুর্খের দেশে পরিনত হচ্ছে। কিভাবে একটি সংসার, একটি সমাজ একটি গোষ্টি একটি ব্যক্তি অন্য আরেকটি সংসার, সমাজ, গোষ্টি ও ব্যাক্তিকে তির মাধ্যমে সর্বপুরী দেশের তি সাধন করছে। মুল কথা আমাদের ভালবাসতে হবে দেশকে দেশের মানুষকে দেশের পরিবেশকে আর এজন্যই প্রয়োজন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় দেশকে ভালবেসে কিভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে বিশ্বের মানচিত্রে একটি সর্বশ্রেষ্ট জাতিতে পরিনত করা যায় তার সুস্পষ্ট উল্লেখ।
কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা
জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা। সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে কারিগরি শিক্ষার অগ্রযাত্রার ফলেই পৃথিবী আজ দ্রুত উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যে শিক্ষা ব্যবস্থায় মানুষ কোনো একটা বিষয়ে হাতে-কলমে শিক্ষা লাভ করে জীবিকার্জনের পথ নির্দেশনা পায় তাকেই আমরা বলতে পারি কারিগরি শিক্ষা বা কর্মসংস্থানমূলক শিক্ষা, কর্মমুখী শিক্ষা অর্থাৎ কারিগরি শিক্ষা হচ্ছে জীবিকা অর্জনের লক্ষ্যে সম্ভাব্য পেশাগত কর্মের কাছে সম্পর্কিত শিক্ষা। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণ হিসেবে এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বহুলাংশে দায়ী করা যায়। ইংরেজ শাসনের সময় একশ্রেণীর কর্মচারী সৃষ্টির জন্যে শিক্ষার ব্যবস্থা পরিকল্পিত হয়েছিলো। সেই কাল থেকেই স্বনির্ভর জাতি সৃষ্টি হয়নি। সাধারণ শিক্ষার একটা প্রবল মোহ অতীতের ঐতিহ্য নিয়ে আজকের দিন পর্যন্ত বিরাজ করছে। বিশেষ বিশেষ বৃত্তির ওপর নির্ভর করে যে সমাজ অতীতে গড়ে উঠেছিলো তার অস্তিত্ব আজকে আর নেই। দেশে বর্তমানে যে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত তাতে জাতির জীবনে উন্নতি আসতে পারে না। সেই জন্যে দরকার দেশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সাধারণ শিক্ষার পরিবর্তে কারিগরি শিক্ষার প্রবর্তন করতে পারলে জাতীয় জীবন হতে বেকার সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব হবে। বিশ্বের উন্নত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যায় যে, তাদের পরিকল্পিত কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে তারা অনেক বেশি কর্মমুখী ও স্বনির্ভর। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায় স্বল্প সময়ে চীন, জাপান, কোরিয়া ও মালয়েশিয়া সহ যে সকল দেশ আজ উন্নতির চরম শিখরে তাদের কারিগরি শিক্ষার গড় মোট শিক্ষিতের হারের ৬০%-এর ওপরে, যা আমাদের দেশে মাত্র ১০% প্রায়। সেটা লক্ষ্য করলে আমরা সহজেই বুঝতে পারি কতোটা পিছিয়ে। বর্তমানে বাংলাদেশে তীব্র বেকার সমস্যা রয়েছে। সাধারণ শিক্ষায় বিএ, এমএ পাস করা অগণিত হতভাগা যুব সমাজ চাকরি নামক সোনার হরিণের আশায় দ্বারে দ্বারে ধরণা দিচ্ছে। কিন্তু সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের চাকুরির ক্ষেত্র একেবারেই সীমিত। তাই দিন দিন বেকার সমস্যা প্রকটতর হচ্ছে। অথচ কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে সহজেই জীবিকার সংস্থান করা যায়। আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষা একেবারে সমপ্রসারিত হয়নি এ কথা বলা যাবে না। বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্র ক্রমেই সমপ্রসারিত হচ্ছে। দেশে প্রকৌশল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২২টি মেডিকেল কলেজ ও একাধিক ডেন্টাল কলেজের মাধ্যমে চিকিৎসা বিদ্যার প্রসার ঘটেছে। এছাড়া ৪টি প্রকৌশল ইনস্টিটিউট, ৪৯টি সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ। এছাড়াও অনেকগুলো টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার, লেদার টেকনোলজি কলেজ, টেঙ্টাইল টেকনোলজি কলেজ, গ্রাফিক আর্ট ইনস্টিটিউট ইত্যাদির মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এতদ সত্ত্বেও দেশের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে তা যথেষ্ট নয়। দেশ ও জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্যে আরো অধিক হারে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন। আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি রয়েছে। প্রয়োজনীয় শিক্ষক-শিক্ষিকা শিক্ষার উপকরণ সরবরাহ, অন্যান্য লোকবল, আর্থিক ব্যয় সঙ্কুলানের ব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও প্রকট সমস্যা বিদ্যমান। এসব সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমান সরকারের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা। আর সে লক্ষ্য অর্জনে কারিগরি শিক্ষা হতে পারে অন্যতম মাধ্যম। তাই আমরা আশা করতে পারি, সরকার তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি নিঃসন্দেহে অধিক মনোযোগী হবে।
শিশু
আজকের শিশুই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। যদি তা-ই হয় তাহলে এই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য শিশুরাতো কোন ভুমিকা পালন করতে পারবে না কারন তার অবুঝ। প্রয়োজন বাবা/মায়ের যথাযথ ভুমিকা । দেশের প্রতিটি মা/বাবা তাদের সন্তানদের মঙ্গল চান কিন্তু আমাদের দেশের অনেক শিতি মাও জানেন না তার সন্তানদের কিভাবে পরিচর্চা করতে হবে। কিভাবে একটা শিশুকে তার শারীরিক মানসিক বিকাশের প্রয়োজনীয়তা অনুসারে লালন পালন করতে হবে কি কি বিষয় একটি শিশুর জন্য তিকারক এবং কি কি বিষয় উপকারী । এ বিষয় গুলো শুধুমাত্র ডাক্তারদের জানলেই হবে না। জানতে হবে আমাদের দেশের প্রতিটি শিতি বাবা/ময়ের। কিন্তু আমাদের শিা ব্যবস্থায় এসব বিষয়ের উল্লেখ নেই। এ জন্য একজন মাকে দারস্ত হতে হয় অনেক অশিতি অভিজ্ঞ মা-দের । এতে করে শিশু বয়সেই শিশুদের মধ্যে তৈরি হয় বৈষম্য । আমার জানা মতে অনেক মা-ই শিশুকে ৩ বছর হতেই বিদ্যালয়ে/নার্সারীতে ভর্তি করিয়ে দেন তারা জানেন এটাই শিশুর জন্য মঙ্গল । আবার অনেক মা ৬ বছর পূর্ন হবার পূর্বে কিছুতেই স্কুলে দিতে আগ্রহী নন তারা জানেন এটাই শিশুর জন্য মঙ্গল। আমার কথা হচ্ছে এ বিষয় গুলো প্রতিটি শিতি বাবা মায়ের জানা উচিত , জানা উচিৎ কিভাবে শিশুর পরিচর্যা করতে হয়, জানা উচিৎ শিশুর খাওয়া দাওয়ার বিষয়ে অর্থাৎ শিশুদের সমস্ত বিষয়ে আমাদের দেশের শিা ব্যবস্থায় স্পষ্ট উল্লেখ থাকা প্রয়োজন যেন আমাদের বাবা/মায়েরা প্রকৃত শিতি হয়ে শিশুর পরিচর্যা করতে পারেন।
বাবা-মা
আমাদের সমাজে একটি সংসার হওয়ার পর সাধারনত এই সংসার নিয়েই প্রতিটি স্বামী স্ত্রী জীবন অতিবাহিত করে থাকে। যেহেতু ভিন্ন দুটি পরিবার হতে ১টি ছেলে ১টি মেয়ে মিলে ১টি সংসার হয় সেহেতু এই সংসারে শিক্ষার গুরুত্ব প্রতিটি মানুষের জীবনে অনেক অনেক বেশী। কিন্তু এই সংসারকে সুচারুরূপে পরিচালনার জন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কোথাও উল্লেখ নাই। একটি সংসারে স্বামীর কি ভুমিকা থাকা উচিৎ স্ত্রীর কি ভুমিকা থাকা উচিৎ, একান্নবর্তী সংসারকে কিভাবে শান্তিময় করা যায় এবং স্বামী স্ত্রী শশুর শাশুরী ননদ ভাসুর অর্থাৎ একটি সংসারের প্রতিটি সদস্যের কিকি আচরনের মাধ্যমে একটি সংসারে বিশৃংঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে এইসব বিশৃংঙ্খলা হতে কিভাবে উত্তরন হওয়া যায়। মনে রাখা দরকার সংসারে শান্তি না থাকলে সমাজে কখনো শান্তি আসবে না। তাই সংসার কিভাকে শান্তিময় রাখা যায় আমাদের পাঠ্য বইগুলোতে তার কিছু বাস্তব উদাহরন বিশদ উল্লেখ করা প্রয়োজন। এতে করে এই শিা সাংসারিক জীবনে কাজে লাগিয়ে দেশ ও দশের উন্নয়ন করা যাবে।
কিশোর, যুবক ও কর্মজীবী
দেশ সমাজ সংসার ব্যাক্তি স্বার্থে আমাদের দেশের কিশোর ও যুবকদের কি ভুমিকা থাকা প্রয়োজন। দেশ ও সমাজ উন্নয়নে এই বয়সেই প্রয়োজন কর্মজীবনে কিভাবে চেইন অব কমান্ড অনুসরন করতে হয়। কিভাবে সবেেত্র ইর্ষামুক্ত হয়ে চলতে হয়। আমরা জানি অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা চিকিৎসা এই পাচটি হচ্ছে প্রতিটি নাগরীকের মৌলিক অধিকার। কিন্তু আমরা জানিনা ট্রাফিক আইন না মানলে কি শাস্তি পেতে হবে, খুন খারাবি করলে কি শাস্তি পেতে হবে, মেয়েদেরকে উত্যক্ত করলে কি শাস্তি পেতে হবে, যেীতুকের কি শাস্তি , ধর্ষনের ফলে কিভাবে কয়েকটি জীবন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কর্মজীবনে অনগ্রসর নারীদেরকে নিরুৎসাহিত না করে উৎসাহিত করলে কিভাবে দেশের উন্নয়ন হয়, ঘোষ কিভাবে সমাজের তির কারন হয়ে দাড়ায়, কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ঘোষ আবদার করলে কিভাবে তা প্রতিহত করতে হয়। আইন শৃংখলা বাহিনীর কি ধরনের মানব বন্ধুসুলভ আচরন করা উচিৎ এবং রাষ্ট্রসেবায় বসে কেউ দুর্নীতি করলে তা প্রতিহত করার জন্য কোথায় নক করতে হবে। মোট কথা এসব বিষয়ে যারা অপরাধী তাদেরকে নিন্দনীয় ব্যক্তি হিসাবে পাঠ্য বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষা দিতে হবে। বাস্তবে দেখা যায় দুর্নীতিবাজ এবং অন্যায়কারীরাই সমাজের উচ্চ শিষরে আহরন করতে পারে এর জন্য আমরাই দায়ী কারন তাদেরকে আমরাই স্বীকৃতি দেই। এটাই স্বাভাবিক কারন এ বিষয়ে যথাযথ জ্ঞ্যান অর্জনের আয়োজন আমাদের শিা ব্যবস্থায় নাই। তাই প্রয়োজন আমাদের ভোটাধিকার কোথায় প্রয়োগ করব। ভোটাধিকার প্রয়োগে ভুল করলে কিভাবে আমরাই এই ভুলের মাসুল দিব সে বিষয়ে যথাযথ জ্ঞ্যান অর্জনের ব্যবস্থা পাঠ্য বইয়েই উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
ইরেজী ভাষাজ্ঞান
আমাদের দেশের শিা ব্যবস্থা যে অবস্থায় গিয়েছে তার উন্নয়ন অতি সহজেই হয়ে যাবে এমনটি আশা করা ঠিক নয়। তবে এখনই উদ্যোগ না নিলে বাংলাদেশের মানুষ সারা বিশ্বের কৃতদাস হয়েই থাকবে। বাংলা ভাষার পাশাপাশি আমাদের দেশের প্রতিটি নাগরিক যেন অষ্টম শ্রেনীর পূর্বেই ইংরেজীতে কথোপকথন করতে পারে সে বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। নট্রামস এর মত সরকারী ভাবে রাজধানীতে একটি ইংলিশ ভাষা শিা কোর্স চালু করা একান্ত প্রয়োজন এবং দেশের শিকদের ইংরেজী ভাষা শিায় পর্যায়ক্রমে একটি পুর্নাঙ্গ কোর্স সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করলে দেশের শিার্থীরা উপকৃত হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশের শিক নিয়োগে ভাবতে হবে ইংরেজী ভাষার দতা এছাড়া ইংরেজী ভাষা শিা বিষয়ে আমাদেরকে জাতীয় ভাবে এক হতে হবে। দেশ ও জাতির উন্নয়নে অবশ্যই ইংরেজী ভাষায় দেশের প্রতিটি নাগরিককে সচেতন হতে হবে।
দেশপ্রেম
দেশ আমাদের । ১৫ কোটি মানুষের কেন্দ্রীয় আশ্রয়স্থল । এই দেশের কোন এক পাড়াগায়ে যদি ১টি বৃ রোপন হয় তাহলে সার্বিক ভাবে এটা দেশেরই উন্নয়ন। আর যদি কোন এক পাড়াগায়ে একটি বৃ নষ্ট হয় তাহলে আমাদের দেশেরই তি। তাই আমাদের থাকতে হবে দেশপ্রেম। আর এজন্যই আমাদের পাঠ্য বইয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে হবে দেশপ্রেম। কিভাবে আমরা নিজেরাই আমাদের দেশের তি করি এবং কিভাবে আমরা নিজেরাই আমাদের দেশের উন্নয়ন করতে পারি এ বিষয়গুলো যেন অন্তরের অন্তস্থলে দেশের প্রতিটি নাগরিক উপলব্দি করে । আমরা যদি কিছুটা সচেতন না হই আমাদের দেশেরই সার্বিক তি। আমাদের দেশের মানুষ অনেক সময় খেতে পায় না পড়তে পারে না । অথচ এদেশেরই মানুষ ১ কোটি বা আরও অধিক মূল্যের গাড়ি মেনেটেন করে তা করতেই পারে কারন প্রত্যেকের ব্যক্তি সাধিনতা রয়েছে। কিন্তু উনাদের নিজেদের মধ্যে যদি আরও সচেতনতা তৈরী করা যায় দেখা যাবে উনারা সামর্থ থাকলেও ১ কোটি টাকার গাড়ি ব্যবহার না করে ১০ লাখ টাকার গাড়ি ব্যবহার করবে যার সামর্থ আছে দশ লাখ টাকার গাড়ি ব্যবহারের সে ব্যবহার করবে ৩ লাখ টাকার গাড়ি। আর বাকি টাকা দেশের দরিদ্র শ্রেনীকে উন্নয়নের জন্য দেশের মধ্যেই নিয়োজিত রাখবে এতে নিজের ও দেশের উন্নতি হবে। কিভাবে বিদেশী পন্য কম ব্যবহার করে দেশী ভাল পন্য ব্যবহার করলে দেশের উন্নতি হবে তারও উল্লেখ থাকা প্রয়োজন পাঠ্য বইয়ে। মুক্তবাজার অর্থনীতির ফলে হয়ত অন্য দেশের পন্যের এন্ট্রেন্স আমাদের দেশে থাকবে কিন্তু দেশের ভোক্তাদের অবশ্যই এই স্বাধীনতা রয়েছে যথাসম্ভব বিদেশী পণ্য বর্জন করা। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে আমরা দেখি এ বিষয়ে জনগনকে কিভাবে উদ্ভুদ্দ করা হচ্ছে। শিশু হতে বৃদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি মগজেই এ বিষয়টি সুস্পষ্ট। বর্তমানে আমাদের দেশের নাগরিকদের দেশপ্রেম নেই বিধায়ই খাদ্যে ভেজাল দ্রব্য মিশানো হয় । কিন্তু আমরাতো এমন ছিলাম না। আমরা বারবার প্রমান করেছি যে দেশের স্বার্থে আমরা সবাই এক। সঠিক নের্তৃত্ত বজায় থাকলে একাত্তরের সেই দেশপ্রেম আমাদের মাঝে আবারও জেঁগে উঠবে। এছাড়া ভেজাল দ্রব্য মিশিয়ে দেশের নাগরিকদের যারা মৃত্যুর মুখোমুখি নিয়ে যাচ্ছে তাদের সকলকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। মিডিয়াতে যারা বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকেন তাদের অবশ্যই কোন মিথ্যা বিজ্ঞাপন প্রচার হতে বিরত থাকতে বাধ্য করতে হবে। দেশী বিদেশী কোন মানুষকে যেন কোথাও হয়রানী করা না হয় মানুষের বিপদে আচরন যেন সৎমানুষের মত হয় তাও উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। কারন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিাই জীবনের ভিত গড়ে তুলতে পারে। আমাদের দেশেরই অনেক মানুষ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে উনাদেরকে স্পেশালভাবে সম্মান করার জন্য জনগনকে শিা দিতে হবে। কারন উনারা প্রিয় দেশ ছেড়ে অনেক দুরে অবস্থান করে দেশেরই উন্নয়নে অংশীদার হিসাবে কাজ করে যাচ্ছেন। উনাদের মাধ্যমে দেশে অনেক বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে তাই কোন ক্রমেই উনাদেরকে হয়রানী করা যাবে না।
প্র্যাকটিক্যাল, লজিক্যাল, টেকনিক্যাল ও সাইন্টিফিক শিক্ষা
আমাদের দেশে মুখস্ত বিদ্যার অনেক দাম। কিন্তু টেকনিক্যাল ও লজিক্যাল বিদ্যার কোন দাম নেই। কারন পাঠ্যসুচীকে এমন ভাবে গঠন করা হয়েছে গদবাধা মুখস্ত না করলে কোন ভাবেই ভাল ফলাফল করা সম্ভব নয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে বিশ্ব এখন আর এই পথে নেই। বিশ্ব এগিয়ে আছে সাইন্টিফিক এবং যৌক্তিক দিক দিয়ে। সারা বিশ্বে আজ এসব বিষয়ে ব্রেইন যাদের শার্প তাদেরই জয়জয়কার। যেমন সফটওয়্যার খাতে লজিক্যাল সেন্স ছাড়া কোন ভাবেই উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের দেশে প্র্যাকটিক্যাল, লজিক্যাল , টেকনিক্যাল ও সাইনটিফিক বিকাশের উল্লেখ যোগ্য কোন সুযোগ নাই। শুধু আছে মুখস্ত বিদ্যার বিকাশের সুযোগ । সেজন্য অকালেই ঝড়ে পরছে দেশের মেধাবী ছাত্ররা। তাই প্রয়োজন পাঠসুচিকে প্র্যাকটিক্যাল , লজিক্যাল , টেকনিক্যাল ও সাইনটিফিক বিষয়ে অধিকতর জোরদার করা।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সমস্যা সমূহ
ইংরেজরা আমাদের দেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে গেছে সেটাকেই আমরা বস্তুবাদী শিক্ষা ব্যবস্থা বলছি। এই শিক্ষা ব্যবস্থা নিরেট কতিপয় উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখেই তৈরি করা হয়েছিল। তাই এটাকে বস্তুবাদী শিক্ষা ব্যবস্থা বলাটাই যুক্তিযুক্ত। ইংরেজ শাসকরা এদেশে এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে, যার উদ্দেশ্য ছিলো ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে থেকে একদল শিক্ষিত মানসিক গোলাম ও প্রভু ভক্ত লোক তৈরি করা, যারা জাতিগতভাবে ভারতীয় থাকবে, কিন্তু মানসিকভাবে হানাদার শাসক ইংরেজদের ধ্যান ধারণায় পরিগঠিত হবে।
বৃটিশরা এসেছিল এদেশে শাসন শোষণ করতে। তাই এদেশীয়দের মধ্যে থেকে তাদের এমন একদল লোক প্রয়োজন ছিলো, যারা তাদেরেক প্রভু মনে করবে, তাদের সভ্যতা সস্কৃতিকে শ্রেষ্ঠ মনে করবে, তাদের আচার আচরণ ও চিন্তা দর্শনকে চমৎকার মনে করবে এবং একান্ত অনুগত বাধ্যগত দাসের ন্যায় দেশ পরিচালনার কাজে তাদের সেবা সহযোগিতা করবে। যে ব্যক্তি তাদের রাজত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে যতো বেশি নিষ্ঠার সাথে সেবা করবে সে নিজেকে ততোবেশি গৌরবান্বিত মনে করবে।
তাদের নিজেদের দেশে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু ছিলো, তা ছিলো রাজ্য শাসন, রাজ্য বিস্তার ও নিজেদের চিন্তা দর্শন বিস্তারের উপযোগী লোক তৈরি করার উদ্দেশ্যে প্রণীত।
সুতরাং নিজেদের দেশে তারা যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে, তা তৈরি হচ্ছিলো সকল ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দানের উপযুক্ত লোক আর জবর দখল করা দেশগুলোতে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে তা থেকে লাভ করছিল প্রভু ভক্ত ও আনুগত্য পরায়ণ লোক। এভাবেই তারা শাসক ও সেবক শ্রেণীর লোক তৈরি করছিল। তাদের চালু করে যাওয়া সেই শিক্ষা ব্যবস্থাই আমাদের দেশে এখনো চালু আছে। এই বস্তুবাদী শিক্ষা ব্যবস্থাটিই আমাদের দেশে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে চালু রয়েছে। এই শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদেরকে একটি স্বতন্ত্র ও আদর্শ সভ্যতা সংস্কৃতির অধিকারী জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়নি। এ শিক্ষা আমাদের জাতিকে মানসিকভাবে করেছে বহুগামী। আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু আমাদের চিন্তাধারা বিচিত্রগামী। এই শিক্ষার অসংখ্য ত্রুটি আছে।
সরকোরের ভুমিকা
জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য শিক্ষা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ অপরিহার্য। প্রকৃতপক্ষে জাতীয় উন্নয়নে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের সুফল আসে ধীরে ধীরে। আর তাই সেটা অনেক সময় তাৎক্ষনিকভাবে আমাদের চোখে পড়ে না। এ কারণেই হয়তো আমাদের দেশে শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ক্রমাগত কমছে। অথচ অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। অর্থনীতিবিদ আর্থার শুলজ্ দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করা সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ এবং উচ্চ শিক্ষায় ১১ শতাংশ। শিক্ষার অর্থনীতি (Economics of Education) নিয়ে গবেষণা করে মৌলিক অবদান রাখার জন্য রবার্ট সলো এবং আর্থার শুলজ্ অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পর্যন্ত লাভ করেন।
বাজেটে শিক্ষা খাতকে প্রধান্য না দেয়া
একটি দেশের মানব সম্পদ উন্নয়নের মধ্যে দিয়ে জাতীয় উন্নয়নের জন্য জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হয়। তাই রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শিক্ষা ফোরাম ২০০৬ বিশ্বের সব দেশগুলোকে তাদের জিডিপি-র কমপক্ষে ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয়ের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকারের প্রয়োজন ছিল শিক্ষা খাতে কমপক্ষে মোট জাতীয় বাজেটের ২৫ শতাংশ এবং জাতীয় আয়ের ৮ শতাংশ বরাদ্দ রাখার। দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে ও জনশক্তিকে মানব সম্পদে রূপান্তরিত করতে শিক্ষার বানিজ্যিকীকরণ প্রবণতা বন্ধ করা এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষা খাতে এ বরাদ্দ জরুরী।
সৃজনশীল শিক্ষায় শিক্ষকের ভূমিকা নিতে সাহায্য না করা
আমাদের দেশে সম্প্রতি শিক্ষা ব্যাবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, আসছেও। শিক্ষার সর্বস্তরে শিক্ষকের ভূমিকাই সব থেকে বেশি। মাধ্যমিক স্তরে বর্তমানে যে সৃজনশীল ব্যাবস্থা চালু হয়েছে তা নির্দ্বিধায় প্রশংসণীয়। কিন্তু যারা এই শিক্ষা প্রদান করবেন তাদের সমস্যাগুলো ভেবে দেখা দরকার। প্রথমত, তারা যে পরিমান বেতন-ভাতা পান তা দিয়ে কি দূর্মূল্যের এই সময়ে সংসার চালানো সম্ভব? আর্থিক অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে আর যাই হোক সুষ্ঠভাবে সিক্ষা প্রদান করা সম্ভব নয়, যদিও আমাদের মহান শিক্ষকগণ সেই অসম্ভবকেও জয় করেছেন, তবুও শিক্ষকদের মধ্যে বিবদমান বেতন বৈষম্য দূর করা উচিত। দ্বিতীয়ত, তাদের সৃজনশীল শিক্ষার উপর পর্যাপ্ত training এর অভাব। আশার কথা এই যে সরকার সম্প্রতি সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর সম্পর্কে training চালু করেছে। তৃতীয়ত, যেহেতু শিক্ষকই হচ্ছেন শিক্ষার মূল চালিকা শক্তি, তাই শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রকৃত মেধাবীদের মূল্যায়ন করতে হবে, নিয়োগ পরীক্ষায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে আর মেধাবীদের এই মহান পেশায় আকৃষ্ট করতে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার ব্যাবস্থা করতে হবে।
শিক্ষার মানোন্নয়নে অভিভাবকদের অসচেতনতা
শিক্ষার বিস্তার ও উন্নয়নে অভিভাবক সম্পৃক্ততা বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার শুরু থেকেই গুরুত্ব বহন করে আসছে । এ সম্পৃক্ততা মূলত দু’ভাবে হয়ে থাকে আইনানুগভাবে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং শিক্ষা বিস্তার ও উন্নয়নে সামাজিক দায়িত্ব হিসাবে অংশগ্রহণ। গবেষণায় দেখা গেছে শিক্ষক ও অভিভাবকদের নিম্নলিখিতভাবে সম্পৃক্ত করে শিক্ষার্থীদের সার্বিক উন্নয়নে সুফল পাওয়া যায়।
যথা:
১) শিক্ষক অভিভাবককে সন্তান সম্পর্কে জানতে, সন্তানের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন বুঝতে এবং বিভিন্ন বয়সের সম্ভাব্য আচরণ ও শিক্ষা সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে সহায়তা করে।
২) বিদ্যালয় ও বাড়িতে সন্তানের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে শিক্ষক-অভিভাবক পরস্পরকে অবহিত করার মাধ্যমে।
৩) বিদ্যালয়ের সময়ের বাইরে অভিভাবক কিভাবে সন্তানকে শেখার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে সে সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দিয়ে ।
৪) শিক্ষার্থীর নিকটবর্তী ও দূরবর্তী লক্ষ্য নির্ধারণে শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থী সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে
৫) বিদ্যালয়ের উন্নয়নে সম্পদ আহরণে পারস্পরিক সহযোগিতা প্রদান করে ।
জীবন পদ্ধতি সম্পর্কে নির্দেশনা বর্জিত শিক্ষা
আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার মূলধারাই যেহেতু আল্লাহ বিমুখ ও ঈমান আকীদা বিবর্জিত দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত, তাই এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে আদর্শিক জীবন ও জীবন পদ্ধতি লাভ করার তো কোনো প্রশ্নই আসেনা। মহান আল্লাহ অহী ও নব্যূয়তের মাধ্যমে মানুষের জন্যে যে হিদায়াত ও জীবন যাপন পদ্ধতি পাঠিয়েছেন, এ শিক্ষা ব্যবস্থা সে সম্পর্কে নিরব। শুধু নীরবই নয়, বরং বিরূপ। এ শিক্ষা ব্যবস্থায় যারা শিক্ষিত হচ্ছে, তারা না ইসলামী জীবন পদ্ধতি যাপন পদ্ধতি পাঠিয়েছেন, এ শিক্ষা ব্যবস্থা সে সম্পর্কে নীরব। শুধু নীরবই নয়, বরং বিরূপ। এ শিক্ষা ব্যবস্থায় যারা শিক্ষিত হচ্ছে, তারা না ইসলামী জীবন পদ্ধতি সম্পর্কে কোনো জ্ঞান লাভ করার সুযোগ পাচ্ছে, না সত্যিকার মুসলিম হয়ে গড়ে উঠতে পারছে আর না জীবন যাপনের সঠিক পথ খুঁজে পাচ্ছে। এর ফলে এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত যুবকদের মধ্যে বহুরংগী জীবন যাপনের প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
প্রকৃত লক্ষ্য বিবর্জিত শিক্ষা ব্যবস্থা
ইসলামী শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো মানুষের মাঝে এক আল্লাহর গোলামি করার প্রবণতা সৃষ্টি করা, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালের মুক্তিলাভের প্রেরণা সৃষ্টি করা, আল্লাহ প্রদত্ত সত্যের সাক্ষ্য হিসেবে নিজেদেরকে পেশ করার যোগ্যতা অর্জন এবং খিলাফত পরিচালনা এবং মানবতার সেবা করার দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করা। কিন্তু আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার ভাবধারা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা লাভকারীরা জীবনের কোনো মহত লক্ষ্য অর্জন করেনা এবং উপরোল্লিখিত শ্রেষ্ঠ গুনাবলী ও যোগ্যতাও অর্জন করতে পারেনা।
নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে ব্যর্থতা
এই আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের নৈতিক দিক থেকে সম্পূর্ণ দেউলিয়া করে ছেড়েছে। গোটা জাতিকে নৈতিক অধ:পতনের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত করে দিয়েছে। এখানে নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টির কোনো মানদন্ড নেই। আদর্শ ও লক্ষ্য বিবর্জিত শিক্ষা ব্যবস্থার ফল এ রকমই হয়। যে শিক্ষা ব্যবস্থা এক আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি করেনা, পরকালের জবাবদিহিতার অনুভূতি সৃষ্টি করেনা, আদর্শ জীবন পদ্ধতির প্রতি উদ্বুদ্ধ করেনা, সে শিক্ষা ব্যবস্থাতো আদতেই মেরুদন্ডহীন। এরূপ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে নৈতিক অবক্ষয় ছাড়া আর কিছুই পাওয়া সম্ভব নয়। এ শিক্ষা ব্যবস্থার কুফলে আমাদের জাতি দিন দিন নৈতিক অধ:পতনের দিকে তলিয়েই চলেছে।
শিক্ষক স্বল্পতা
শিক্ষক স্বল্পতাও শিক্ষা ব্যবস্থার একটি বড় সমস্যা। বিদ্যালয় সমূহে ৬০:১ অনুপাতে শিক্ষক থাকার নিয়ম থাকলেও কোনো বিদ্যালয়েই সে অনুপাতে শিক্ষক নেই। সাধারণত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক দরকার আট জন। কিন্তু শিক্ষক থাকে পাঁচ/ছয় জন। ফলে প্রয়োজনীয় শিক্ষক স্বল্পতার কারণে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শিক্ষিকারা বলেন, আমরা সবাই মিলে বিরতি ছাড়া এক নাগাড়ে ক্লাস নিলে পাঠদানের সমস্যা সমাধান করা যায়। কিন্তু আমাদের যে পরিমাণ সরকারি কাজ করতে হয় সেগুলো করতে হিমশিম খেয়ে যাই। শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির তালিকা তৈরি, বিভিন্ন ধরণের চারুকারুর কাজ ও সরকারি অন্যান্য কাজ করতে একজন শিক্ষককে পুরোমাস অফিসে বসে থাকতে হয়। ফলে একজন শিক্ষক মত ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও ক্লাস নিতে পারেন না বলে তিনি জানান।
শিক্ষকদের ওপর ম্যানেজিং কমিটির প্রভাব শিক্ষা কার্যক্রমেরএকটি অন্তরায়। বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের অনেক সদস্য গম পাওয়ার অযোগ্য অনেক ছাত্রছাত্রীদের কার্ড দেওয়ার জন্য শিক্ষকদের অবৈধভাবে চাপ দেয় অথবা প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। ফলে কোথাও কোথাও শিক্ষক এবং ম্যানেজিং কমিটির মধ্যে দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। এ সকল দ্বন্দ্বের কারণে শিক্ষা ব্যাহত হয় বলে তিনি জানান।
শিক্ষকের অন্য পেশায় জড়িত থাকা
শিক্ষকের শিক্ষকতা ছাড়াও অন্য পেশায় জড়িত থাকতে দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে হাজির হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেন, শিক্ষকদের যে বেতন ভাতা দেওয়া হয় তাতে অনেক শিক্ষক সংসারের খরচের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। ফলে শিক্ষকরা অন্য পেশায় জড়িত হয়।
প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হলেও গ্রামাঞ্চলের অনেক শিশু বিদ্যালয়ে আসে না। নরোত্তমপুর ইউনিয়নের ফলাহারী গ্রামের অভিভাবক আবুল খায়ের মিয়া বলেন, শিশুদের বিদ্যালয়ে না আসার প্রধান কারণ দারিদ্র্য এবং অভিভাবকদের মাঝে মান্ধাতার আমালের ধারণা। অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের নিজের কিংবা অন্যের শ্রমে নিয়োজিত করে। পড়ালেখা শিখিয়ে কি লাভ, এ ধারণা পোষণ করে অনেক অভিভাবক ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠায় না। শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য সম্পর্কে আবুল খায়ের মিয়া বলেন, শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্প চালু হওয়ায় বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীদেরও নৈতিকতার মৃত্যু ঘটেছে। কারণ এ প্রকল্প চালু হওয়ায় বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক, শিক্ষক ও পরিচালনা পরিষদের মধ্যে দুর্নীতি আশ্রয় নিয়েছে। তিনি ছাত্রছাত্রীদের গম কিংবা উপবৃত্তি না দিয়ে তাদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করতে সুপারিশ করেন। আগের তুলনায় বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মান সবদিক দিয়ে ভালো বলে মন্তব্য করেন অশ্বদিয়ার বদরপুর গ্রামের আসাদুজ্জামান চৌধুরী। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপকরণের অভাব, শিক্ষক স্বল্পতা, শিক্ষকদের দায়িত্বে অবহেলা এবং কিছু শিক্ষকের দক্ষতার অভাব থাকায় শিক্ষার মান কমছে। প্রাথমিক স্তরে গ্রাম ও শহর এবং সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষার বিদ্যমান সমস্যাসমূহ সমাধান করলে গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক শিক্ষার মান আরো উত্তোরত্তর সমৃদ্ধি পাবে।
সৃষ্টিকর্তা বিমুখ শিক্ষা ব্যবস্থা
বৃটিশদের চালু করে যাওয়া শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন সময় কিছু কিছু সংস্কার ও মেরামতের কাজ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই শিক্ষা ব্যবস্থার মূলধারা নিরেট আল্লাহ বিমুখ জড়বাদী দর্শনের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই পৃথিবী এবং এই মহাবিশ্ব কে সৃষ্টি করেছেন? কি উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন? আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় এর জবাব নাস্তিকতার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। কিংবা সংশয়বাদী ধারণা পেশ করা হয়েছ।
এই বিশ্ব জগতের যে একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন, তিনিই যে গোটা মহাবিশ্ব অত্যন্ত বিজ্ঞতার সাথে পরিচালনা করেছেন, তিনিই যে মানুষকে বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন, মানুষের জীবন যাপনের জন্যে জীবন দর্শন ও জীবন বিধান দিয়েছেন, আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার এই দৃষ্টিভংগি অনুপুস্থিত।
ঈমানি দর্শন বর্জিত শিক্ষা ব্যবস্থা
আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষকে সঠিক জীবন দর্শন দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আল্লাহ, আল্লাহর একত্ব, রিসালাত, আল্লাহ প্রদত্ত হিদায়াত, পরকাল, আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতা, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি ঈমানি দর্শনের ধারণা বিবর্জিত এ শিক্ষা ব্যবস্থা আর্দশবাদী মানুষ তৈরি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এ শিক্ষা ব্যবস্থা পরকালে বিমুখ দুনিয়া পূজারী মানুষ তৈরি করে। মানুষকে তার শাশ্বত জীবনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা এখানে নেই। মানুষের প্রকৃত কল্যাণ অকল্যাণ, জীবনের আসল ব্যর্থতা ও সার্থকতা জানবার ব্যবস্থা এখানে নেই। ঈমান বিবর্জিত বস্তুবাদী দর্শনই এ শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ভিত্তি।
নেতৃত্ব ও দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে ব্যর্থতা
আমরা আগেই আলোচনা করে এসেছি, এ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল বৃটিশদের মানসিক দাস আর অনুগত সেবক তৈরি করার জন্য। এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে স্বাধীন দেশ ও জাতিকে পরিচালনা করার যোগ্য নেতৃত্ব ও দক্ষ জনশক্তি তৈরি হবার আশা করা যায়না। নিজ দেশের উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্যে আত্মত্যাগী শিক্ষিত মানুষ এখান থেকে বের হবার আশা করা যায়না। তাইতো দেখা যায়, জাতির মেধাবী লোকেরা স্বদেশ থেকে বিদেশেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টিতে ব্যর্থতা
এ শিক্ষা ব্যবস্থা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এ শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে মানসিকভাবে বহুমত ও পথের অধিকারী বানিয়ে দেয়। একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা মানসিকভাবে পরস্পরভাবে পরস্পরের শত্রু হয় গড়ে উঠে। ছাত্র জীবন শেষে তারা বিভিন্ন মত ও পথে পরিচালিত হয় এবং জাতিকেও বিভিন্ন পথ ও মতের দিকে ধাবিত মত ও পথে পরিচালিত হয় এবং জাতিকেও বিভিন্ন পথ ও মতের দিকে ধাবিত করবার চেষ্টা করে। ফলে জাতির মধ্যে দিন দিন হানাহানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনৈক্য প্রসারিত হচ্ছে। ঐক্য ও সংহতির বন্ধন একেবারে শিথিল হয়ে পড়েছে। জাতি অসংখ্য মত ও পথের অনুসারী হয়ে পড়েছে।
সন্ত্রাস
শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক দেউলিয়াত্বের কারণে শিক্ষার্থীরা ব্যাপকভাবে সন্ত্রাসের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সন্ত্রাস আজ আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার অপরিহার্য অংগে পরিণত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এখানকার শিক্ষকরা সন্ত্রাসের দ্বারা আক্রন্ত হচ্ছে। সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে দেখা দেয় সেশনজট। তাতে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির শেষ নেই।
স্বার্থান্বেষী চিন্তা-ভাবনা
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা স্বার্থপর, স্বার্থন্বেষী নিরেট বস্তুবাদী দৃষ্টিভংগির লোক তৈরি করছে। আমরা প্রত্যেকেই কেবল নিজের জন্য আগে চিন্তা করে অতঃপর অন্যদের জন্য বা দেশের জন্য চিন্তা করি। কারন শিক্ষা ব্যবস্থার মূলে রয়েছে বৃটিশদের দেয়া কিছু অনৈতিক চিন্তা ধারা ও অমানসিক জীবন ব্যবস্থার মাপকাঠি। কারণ এ মুখস্তনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিটি শিক্ষার্থীকে কেবল একজন কেরানী হওয়ার উপযুক্ত করে তৈরী করে তোলে।
দুর্নীতির প্রসার
দুর্নীতি আমাদের জাতি সত্তার অংশে পরিণত হয়েছে। এই শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসছে জঘণ্য ঘুষখোর, চোরাকারবারী, মানুষের অধিকার হরণকারী, আইনকানুন ও নিয়মশৃংখলা লংঘনকারী, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, স্বজনপ্রীতিকারী, যুলুমবাজ, মদখোর, মদখোরা, জুয়াবাজ, ফাঁকিবাজ, প্রতারক, চোর, ডাকাত ইত্যাদি। শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্যে, আদর্শ মানুষ তৈরির মাধ্যমে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা। আর আমাদের ভাগ্যে জুটেছে এর বিপরীত ফল। আমরা এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রেখেছি, যা দুর্নীতি শিক্ষা দিচ্ছে এবং এর শিক্ষার্থীরা দুর্নীতির কাজে দক্ষ হয়ে বেরুচ্ছে।
ধর্মীয় শিক্ষার লেজুড়
অবস্থার প্রেক্ষিতে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার গোটা ধর্মীয় ভাবধারার সাথে ইসলামিয়াত ও ইসলামের ইতিহাসের লেজুড় জুড়ে দেয়া হয়। ইসলামিয়াতকে নিচের শ্রেণীগুলোতে কখনো ঐচ্ছিক, কখনো বাধ্যতামূলক রাখা হয়। উক্ত শ্রেণীতে ইসলামিয়াত ও ইসলামের ইতিহাস ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখা হয়।
ইসলামের ইতিহাস নামে এমন ইতিহাস ছাত্রদের পড়ানো হয়, যাতে ইসলামকে বিকৃত এবং ইসলামের ইতিহাসকে স্বার্থপরতা ও যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাস হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ফলে এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যারা পাশ করে বের হয় তারা ইসলামের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যায়। বরং অনেকেই একেবারে ইসলাম বিদ্বেষী হয়ে বের হয়। ইংরেজ শাসকরা মুসলিম যুবকদের ইসলাম বিদ্বেষী বানাবার একটি মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ইসলামের ইতিহাস বিভাগ চালু করে। অমুসলিমদের লেখা ইতিহাস এখানে ছাত্রদের পড়ানো হয়। এ বিভাগের মাধ্যমে ইসলামকে একটি জঘণ্য মানবতা বিরোধী ধর্ম হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এ বিভাগের মাধ্যমে বৃটিশরা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার নীতি গ্রহণ করে।
ইসলামিয়াত বা ইসলামী শিক্ষা নামে এ বিষয়টি চালু করা হয়েছে তাতে ইসলামের পূর্ণাংগ ধারণা দেয়া হয়না। তবে যতটুকু ধারণাই দেয়া হয় তার ফলাফল ইসলামের পক্ষে খুব একটা যায়না। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে।
পহেলা কারণ হলো, নিচের শ্রেণীগুলোর ইসলামিয়াত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী শিক্ষা বিভাগে ইসলামকে পূর্ণাংগ জীবন দর্শন ও জীবন ব্যবস্থা হিসেবে শিক্ষা দেয়া হয়না। ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করবার প্রতিও গুরুত্বরোপ করা হয়না।
ইসলামিয়াত বিষয়টি গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে পরগাছার মতো। ছাত্রদের অন্য সকল জ্ঞান বিজ্ঞান এমনভাবে শিক্ষা দেয়া হয়, পরকাগাছার মতো। ছাত্রদের অন্য সকল জ্ঞান বিজ্ঞান এমনভাবে শিক্ষা দেয়া হয়, যার ফলে গোটা বিশ্বজগত আল্লাহ ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে এবং সফলভাবে পরিচালিত বলে তারা অনুভব করে। আল্লাহ রসূল ও পরকালের প্রয়োজনীয়তাই তারা অনুভব করেনা। ছাত্রদের গোটা চিন্তাধারাই এ দৃষ্টি ভংগিতে গড়ে তোলা হয়। অতপর ইসলামিয়াতের ক্লাসে মৌলভি সাহেব আল্লাহ, রসূল, কিতাব ও পরকাল আছে এবং এগুলোর প্রতি ঈমান আনতে হবে বলে শিক্ষা দেন।
একদিকে সামগ্রিকভাবে ছাত্রদের মধ্যে আল্লাহ বিমুখ দৃষ্টিভংগি সৃষ্টি করা হচ্ছে, অপরদিকে ইসলামিয়াতে ক্লাসে আল্লাহমুখী শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। ছাত্রদের সামগ্রিক দৃষ্টিরভংগির সাথে ইসলামিয়াতের শিক্ষাটা পরগাছার মতোই থেকে যাচ্ছে এবং তাদের দৃষ্টিভংগির কাছে চরমভাবে মার খাচ্ছে। নিরানব্বই মণ লবণের সাথে এক মণ চিনি মিশালে সে চিনি লবণের সাথে বিলীন হয়ে যেতে বাধ্য।
এভাবেই প্রবল আল্লাহ বিমুখ দৃষ্টিভংগি গড়ে তুলে তার উপর আল্লাহমুখী হালকা ধারণা পেশ করে ছাত্রদের মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে দেয়া হয় এবং সে দ্বন্দ্বে বেচারা পরগাছা ইসলামিয়াত চরমভাবে পরাজিত হয়। এর ফলে ইসলামের বিরোধিতায় তারা সাহসী হয়ে উঠে।
এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলাম শিক্ষা বা ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের কথায় আসা যাক। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব চাইতে ঘৃণীত বিভাগ সম্ভবত এটি। এ বিভাগের ছাত্র শিক্ষকরা মোল্লা মৌলবাদী খেতাবে ভূষিত। এবিভাগের ছাত্রদের কর্মপোযোগী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। এ বিষয়ে পাশ করার পর তাদের না সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয় আর না সিভিল প্রশাসনে। কোনো প্রকারে ইসলামিয়াতের শিক্ষকতা করে তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তাদের সামাজিক মর্যাদাকে হেয় করে দেখা হয়। মোট কথা ধর্মীয় শিক্ষার এই লেজুড় ও পরগাছা থেকে ছাত্ররা:
ক. ইসলামকে পূর্ণাংগ জীবন দর্শন ও জীবন ব্যবস্থা হিসেবে জানতে পারেনা।
খ. ইসলামকে হানাহানি কাটাকাটির ধর্ম ও মানবতা বিরোধী বলে শিক্ষা লাভ করে।
গ. তাদের মনে ইসলাম সম্পর্কে খারাপ ধারণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়।
ঘ. ইসলামকে একটি খেল তামাশার বিষয় হিসেব গ্রহণ করে।
ঙ. এটাকে সমাজের জন্যে কল্যাণকর মনে করা হয়না।
মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা
আমাদের দেশে বর্তমানে মাদ্রাসা শিক্ষার দুটি ধারা চালু আছে। একটি হলো দারসে নেজামি পদ্ধতি। এ পদ্ধতির মূল আদর্শ দেওবন্দ মাদ্রাসা। অপরটি হলো আলীয়া পদ্ধতি। এ পদ্ধতি সূচনা হয় কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এ পদ্ধতি শ্রেণী ভিত্তিক এবং এতে আধুনিক শিক্ষার কিছুটা লেজুড় লাগানো হয়েছে। এই দুই ধারার মাদ্রাসা শিক্ষার মধ্যে মৌলিক তফাতে খুব কমই। মূলত উভয় ধারাই মুসলিম শাসন আমলে ভারতবর্ষে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু ছিলো, তারই শিক্ষাক্রমের অনুসারী।
মোটকথা, আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা কয়েক শতাব্দীর প্রাচীন ও জরাজীর্ণ। মুসলিম শাসনামলে এ শিক্ষা ব্যবস্থা ছিলো যুগ উপযোগী। তখন এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকেই সরবরাহ হতো রষ্ট্র নায়ক, রাষ্ট্র পরিচালনার কর্মকর্তা ও কর্মচারী। সামরিক বিভাগের কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী কুটনীতিকসহ সকল শ্রেণীর দায়িত্বশীল লোক।
এরপর বৃটিশরা এলো। তারা তাদের ধাঁচের রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে এবং সেই রাষ্ট্রে কর্মচারী হবার উপযোগী লোক তৈরি করবার মতো শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে।
গোটা বৃটিশ আমলে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা তার প্রচীনত্ব নিয়ে চলতে থাকে। বৃটিশরা চলে যাবার পর দেশ স্বাধীন হলো। পাকিস্তান নামের স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো। অতপর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলো। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা তার প্রাচীনত্ব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। প্রাচীনত্ব নিয়েই সে এখনো ভবিষ্যত্বের পথে এগিয়ে চলেছে।
ইতিহাস এগিয়ে চলেছে। ভারতবর্ষে মুসলিম সম্রাজ্যের পতন হয়। দেশ বিভক্ত হয়। পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে। সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে। শিল্প ও বাণিজ্য ব্যবস্থার বিবর্তন ঘটে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। মানুষের চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভংগির মধ্যে পরিবর্তন আসে। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা তার সেই প্রাচীন ঐতিহ্য ও শিক্ষাক্রমকে বুকে ধারণ করে পাহাড়ের মতো অটল আবিচল হয়ে পড়ে আছে আপন স্থানে।
ফলে যুগ ও কালের যতোই পরিবর্তন হতে থাকলো ততোই এ শিক্ষা ব্যবস্থা তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলতে থাকলো। এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে যারা শিক্ষা লাভ করে বেরুতে থাকলো, সমকালীন সমস্যাবলী ও জীবনধারার সাথে তারা সম্পর্কহীন হয়ে পড়লো। এখন এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে যারা শিক্ষা লাভ করে বেরুচ্ছে, তাদের জন্যে মসজিদের ইমামতি, মাদ্রাসা ও মক্তব্যের শিক্ষকতা, ইসকুলের ধর্ম শিক্ষকের পদ অলংকরণ আর ধর্মীয় বাহাছ বিতর্কের তুফান ছুটানো ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা নিম্নোক্ত ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো দ্বারা জর্জরিত।
১. মূল শিক্ষা ব্যবস্থাটিই বহু শতাব্দীকালের প্রাচীন এবং বর্তমান কালের কার্যকারিতা বর্জিত।
২. শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি যুগের চাহিদার অনুপূরক নয়।
৩. এখানে যুগ উপযোগী রাষ্ট্র বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজ বিজ্ঞান, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, বাণিজ্যনীতি, পররাষ্টনীতি, আইন ও বিচারনীতি, কৃষি ও কারিগরী শিক্ষা দানের কোনো ব্যবস্থা নেই। এগুলো শেখার জন্যে মাদ্রাসা ছাত্রদেরকে মাদ্রাসা পাশ করার পর পুনরায় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়। তাও সকল ক্ষেত্রে এবং সকলের জন্যে ভর্তি হওয়া সম্ভব হয়না।
৪. এখানে প্রাচীন ফিকহ শাস্ত্রের উপরই অত্যধিক গুরুত্বারোপ করা হয়। স্বাধীন চিন্তা, গবেষণা ও ইজতিহাদের দরজা এখানে সম্পূর্ণ বন্ধ।
৫. এখানে কুরআনের প্রাচীন তাফসীরই পড়ানো হয়। তবুও পূর্ণাংগ কুরআন পড়ানো হয়না। কুরআনের উপর গবেষণাধর্মী পড়ালেখার কেনো ব্যবস্থা এখানে নেই।
৬. হাদীস শাস্ত্রের একই অবস্থা। হাদীসের উপর গবেষণাধর্মী পড়া লেখার কোনো ব্যবস্থা নেই। হাদীস যাচাই বাছাই করার মতো যোগ্যতা অর্জন করবার কোনো সুযোগ এখানে নেই।
৭. ইসলামকে পূর্ণাংগ জীবন দর্শন ও ব্যবস্থা হিসেবে শিক্ষাদান ও শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা এখানে নেই। ফলে এই শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ইসলামকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে চালু করবার শিক্ষা ও কর্মপন্থা জানা যায়না।
৮. এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে সিভিল সার্ভিসের জন্যে লোক তৈরি হয়না। সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা হবার যোগ্য লোক তৈরি হয়না। কুটনীতিক তৈরি হয়না। শিল্প ও বাণিজ্য পরিচালনার যোগ্য লোক তৈরি হয়না। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ তৈরি হয়না। রাষ্ট্র নায়ক তৈরি হয়না। ফলে এখান থেকে যারা শিক্ষা লাভ করে বেরুচ্ছে, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার কী পোস্ট গুলোতে তাদের স্থান হয়না।
৯. এখান থেকে যারা শিক্ষা লাভ করে বেরুচ্ছে, তারা সমাজে সত্যিকারভাবে মর্যাদাবান হতে পারছেনা। ধর্মীয় কারণে কিছুটা ভক্তি শ্রদ্ধা তারা লাভ করেন বটে, কিন্তু রাষ্ট্রীয়,প্রশাসনিক ও সামাজিক পদমর্যাদা তারা অধিষ্ঠিত হতে পারছেনা। ফলে সমাজে তাদের ছোট ও হেয় হয়ে থাকতে হয়।
১০. এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে যেহেতু রাষ্ট্র ও সমাজের জন্যে দক্ষ জনশক্তি লাভ করা যায়না, সে কারণে মাদ্রাসা গুলো সরাসরি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থেকেও বঞ্চিত।
১১. মাদ্রাসাগুলোতে যারা শিক্ষা দান করেন, তারাও অদক্ষ। তাদের ও কর্মহীনতার কারণে তারা ব্যাপকহারে ধর্মীয় বাহাছ বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। ফলে সারাদেশে ধর্মীয় কোন্দল জাল বিস্তার করে আছে।
১২. মাদ্রাসাগুলো থেকে যারা শিক্ষা লাভ করে বের হয়, অদক্ষতা ও কর্মহীনতা কারণে তারা ব্যাপকহারে ধর্মীয় বাহাছ বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। ফলে সারাদেশে ধর্মীয় কোন্দল জাল বিস্তার করে আছে।
১৩. সামগ্রিকভাবে জাতি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি হতাশ ও আস্থাহীন হয়ে পড়েছে। যেহেতু ধর্মীয় পরিমন্ডলের বাইরে এখান থেকে শিক্ষা লাভকারীরা সমাজ পরিচালনা ও সমাজে আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করবার যোগ্যতা অর্জন করেনা, সেজন্যে অভিভাবকরা সাধারণত তাদের সন্তানদের মাদ্রাসায় ভর্তি করাননা। কেবল তিনটি কারণে মাদ্রাসায় পড়তে আসে:
ক. একান্ত ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করার কামনায়।
খ. মাদ্রাসা শিক্ষা শেষ করার পর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তী হবার নিয়্যতে।
গ. গরীব লোকরা আর্থিক অনটনের কারণে তাদের সন্তানদের মাদ্রাসায় পাঠায়।
এই তিনটি কারণে যারা মাদ্রাসায় পড়তে আসে তাদের সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল। ছাত্রের অভাবে বহু মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। টিকে থাকার জন্য বাধ্য হয়ে বহু মাদ্রাসাকে ছাত্র সংখ্যা যা নয়, তার চাইতে বাড়িয়ে দেখাতে হচ্ছে।
এথেকেই বুঝা যায়, মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি সামগ্রিকভাবে অনাস্থা কতো প্রবল এবং এ শিক্ষা ব্যবস্থা কতোটা সেকেলে এবং অকেজো হয়ৈ পড়েছে। মেরামত করে কাজ হবেনা।
আধুনিক বস্তুবাদী শিক্ষা ব্যবস্থা এবং প্রাচীন মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার এইসব দুর্গতি দেখে বিভিন্ন সময় এগুলোকে মেরামত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। পাকিস্তান আমল পর্যন্ত মাদ্রাসাগুলোতে উর্দূ মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া হতো। বাংলাদেশ আমলে আলীয়া পদ্ধতিতে বাংলা মাধ্যম চালু করা হয়েছে। দারসে নিযামি পদ্ধতি এ ক্ষেত্রে এখনো সংস্কার করেনি। বিভিন্ন সময় আলীয়া পদ্ধতি বাংলা, ইংরেজি, অংক, সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় এবং কোথাও কোথাও কিছু কিছু শ্রেণীতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের কিছু কিছু বিষয় চালু করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক কাঠামোর সাথে এগুলো খুব একটা খাপ খায়নি। ফলে এসব মেরামত/সংস্কার দ্বারা মূল অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।
আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায়ও বিভিন্ন সময় সংস্কার মেরামত করার চেষ্টা করা হয়েছে। শিক্ষাক্রমের উন্নতি সাধন করার চেষ্টা করা হয়েছে। নতুন ধরনের শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিভিন্ন সময় শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে এবং বিভিন্ন প্রকার সংস্কার প্রস্তাব আনা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন নতুন বিষয় ও বিভাগ চালু করা হয়েছে। কিন্তু বৃটিশদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম ও শিক্ষা ব্যবস্থার মূল ভাবধারায় তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার পরীক্ষাগারে, সাধারণ ছাত্র ছাত্রী গিনিপিগ হিসাবে ব্যবহ্নত হচ্ছে। এই শিক্ষা ব্যবস্থার পরীক্ষাগারে পরীক্ষা নিরীক্ষায় সধারন ছাত্র ছাত্রীর জীবন অতিষ্ঠিত।’গ্রাম পুরে ছাই হয়ে যাক, তাতে কি, আমার গায়ে আগুনের উত্তাপ চাই’। এই হলো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নীতি নির্ধারকদের ভুমিকা। এত সবের পরেও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কাছুটা হলেও উন্নতির পথে এও কম কথা নয়, কিন্তু এখানেও সমস্যা। সেশন জট, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস ইত্যাদি, কিন্তু কেন? এর উত্তর খোজলে একাধিক কারনের মধ্যে যে কারনটি বিশেষ ভাবে লক্ষ্যনীয়, তা হলো ছাত্র রাজনীতি।
বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতি মানেই লেজুর বৃত্তি। স্বর্থের আশায় একে অন্যের পা চাটা। ছাত্র রাজনীতি মনেই পিতার স্কন্ধে সন্তানের লাশ, অকালে তরতাজা প্রান ঝরে যাওয়া। ছাত্র রাজনীতি মানেই চর দখলের মত হল দখলের স্বসস্ত্র মহড়া। ছাত্র রাজনীতি মানেই রাজনৈতিক দলের শক্তি বৃদ্ধি করা।ছাত্র রাজনীতি মানেই ছাত্রীতে ছাত্রীতে চুলাচুলি, দিগম্বর করে অপমান করা। ছাত্র রাজনীতি মানেই ন্যায্য প্রতিবাদের ভাষা রোধ করে দেয়া আর যা ইচ্ছে তাই করা, বম ফাটানো, কথায় কথায় গাড়ী ভাঙ্গা, যাকে তাকে আক্রমন চালানো, লুটপাট, চাদাবাজী ইত্যাদি ইত্যাদি।
ছাত্র রাজনীতি নিয়ে অভিভাবক মহলে আতংকের শেষ নেই। কারণ ছাত্র রাজনীতির নামে কোন বাবাই দেখতে চাননা তার যুবক ছেলের লাশ কিংবা সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ। তাই অভিভাবক মহল ছাত্র রাজনীতি নামের লেজুর বৃত্তির রাজনীতি বন্ধের পক্ষেই অভিমত পোষন করেন। কিন্তু কোন কোন বুদ্ধিজীবী আবার ছাত্র রাজনীতি বন্ধের তীব্র সমালোচনাও করেন। যুক্তি দেখান ছাত্র রাজনীতি বহালের পক্ষে। কিন্তু তাদের এই যুক্তি কতটুকু গ্রহন যোগ্য তাও বিবেচ্য বিষয়।
অবকাঠামোর সমস্যা
শিক্ষানীতির প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করতে যে বিনিয়োগ ঘটাতে হবে, তা কিন্তু মোটেই সহজ নয়। প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রলম্বিত করা, শিক্ষক-ছাত্রের অনুপাত ১:৩০, বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের জন্য কমিশন, উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষা উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত প্রলম্বিত করা এবং স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশন স্থাপন করা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য সামনে রেখে এই শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার সচেতনতা থেকে শুরু করে সামাজিক মূল্যবোধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, বৈষম্যহীন আর্থসামাজিক পরিবেশ, মানুষের প্রতি সহমর্মিতা, গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতা উৎসাহিত করা, শিক্ষার অনুকূল আনন্দময় পরিবেশ তৈরি এবং শিক্ষার সর্বস্তরে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির ব্যবহার এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
শিক্ষার উন্নয়নে আমাদের অঙ্গীকার যতই প্রবল হোক না কেন, অন্যান্য উন্নয়নকামী দেশের মতোই সীমিত সম্পদের সুবিশাল চাহিদার দেশে যোগ্য বিনিয়োগ ঘটানো নিঃসন্দেহে কঠিন বিষয়। সুযোগ্য ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে ইতিমধ্যে বিদ্যালয়গুলোতে যথাসময়ে বিনা মূল্যে পুস্তক সরবরাহের কাজটি যে সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে, তা অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, ২০০১-০২ সালে শিক্ষায় জাতীয় বাজেটের শতকরা ৮ দশমিক ৩৪ ভাগ বরাদ্দ ছিল, অথচ তা ২০১০-১১ সালে নেমে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৪৩ ভাগে। এই তথ্যটি নতুন শিক্ষানীতির বাস্তবায়নে আমাদের অঙ্গীকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বর্তমান শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য সম্পদের যে বিনিয়োগ ঘটাতে হবে, তা স্বাধীন বাংলাদেশ কখনো এর আগে প্রত্যক্ষ করেনি। এর মধ্যে যদি ১০ বছর আগের বরাদ্দের থেকেও জাতীয় বাজেটের ভগ্নাংশ হ্রাস পেতে থাকে, তাহলে তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কিছুদিন আগে একটি পরিসংখ্যান নজরে পড়ল—প্রাথমিক শিক্ষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু ব্যয় পাঁচ হাজার ডলারের বেশি, নেপাল ও ভারতে তা মাত্রই ১৩ ডলার, স্বাধীন বাংলাদেশে নিশ্চয়ই আরও কম। সুতরাং, শুধু কথায় নয়, প্রকৃতপক্ষে শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করার কোনো বিকল্প নেই।
প্রাইভেট টিউশনি ও বিদ্যালয় ব্যবস্থা
প্রাইভেট টিউশনি নিয়ে সাম্প্রতিককালে নানা মহলে উদ্বেগ বাড়ছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত অভিভাবকদের এ উদ্বেগ বেশি। শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ার খরচ অনেক অভিভাবকই বহন করতে সক্ষম নন; কিন্তু কষ্ট করে অভিভাবকদের এ খরচটুকু জোগাড় করতে হচ্ছে। শিক্ষাবিদ ও শিক্ষার নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও এ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ার প্রবণতা যেভাবে বেড়েছে, তা অতীতে কখনও দেখা যায়নি। অপরদিকে শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে যথাযথভাবে না পড়িয়ে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানোয় আগ্রহী বলেও কথা উঠেছে। ফলে কিছুদিন আগে একবার শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো বন্ধে আইন প্রণয়নের কথা শোনা গিয়েছিল। সম্প্রতি অবশ্য এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য শোনা যাচ্ছে না।
আমাদের দেশে প্রাইভেট পড়া বা পড়ানোর প্রবণতাটি নতুন কিছু নয়। গ্রামাঞ্চল বা মফস্বল শহরে আগে বাড়িতে শিক্ষক রেখে বা শিক্ষকের বাড়িতে ব্যাচে পড়ানো হতো। যেসব শিক্ষার্থী পড়ালেখায় দুর্বল ছিল, যাদের পঞ্চম বা অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পাওয়ার কিংবা এসএসসি বা এইচএসসিতে প্রথম বিভাগ বা স্টার মার্কস পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল, মূলত তাদের বিদ্যালয়ের পড়াশোনার বাইরেও আলাদা প্রাইভেট পড়তে হতো। অনেক সময় বিদ্যালয় থেকেই এ ধরনের আয়োজন করা হতো– বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষক উদ্যোগী হয়ে ভালো ও দুর্বল শিক্ষার্থীদের বাড়তি পড়ার ব্যবস্থা করতেন। অন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা প্রাইভেট পড়ত, তাদের অধিকাংশই ইংরেজি বা গণিত বা এরকম কোন ‘কঠিন’ বিষয়ে প্রাইভেট পড়ত। বর্তমান সময়ের চিত্র পুরোপুরি অন্যরকম। এখন এমন শিক্ষার্থীও রয়েছে, যাদের সব বিষয়ে প্রাইভেট পড়তে দেখা যায়। আগে যে বিষয়গুলোতে (বাংলা, সমাজ, ধর্ম ইত্যাদি) প্রাইভেট পড়ার কথা অনেকে ভাবতই না, শিক্ষার্থীরা এখন সেসব বিষয়েও প্রাইভেট পড়ছে। বলা বাহুল্য, এ প্রবণতা গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলে বেশি।
প্রাইভেট পড়ার এ প্রবণতা উচ্চমাধ্যমিক বা মাধ্যমিক পর্যায় ছড়িয়ে প্রাথমিক পর্যায়েও হানা দিয়েছে। গবেষণা থেকে দেখা যায়, ২০০৫ সালে সারাদেশে প্রথম শ্রেণীর ২২.৩ ও পঞ্চম শ্রেণীর ৩৮.৪ শতাংশ শিক্ষার্থী অর্থের বিনিময়ে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ছে। মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের এবং গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ার হার বেশি। প্রাথমিক পর্যায়ে এই প্রাইভেট পড়ার হার প্রতি বছর দুই শতাংশ করে বাড়ছে (সমীর রঞ্জন নাথ, ২০০৬)। এই চিত্র উদ্বেগজনক। ফলে প্রাইভেট টিউশনি পদ্ধতিটি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার সময় এসেছে।
প্রাইভেট পড়ার রীতি সব সময়ই ছিল; কিন্তু আগেকার দিনের প্রাইভেট পড়ার সঙ্গে এখনকার কিছু পার্থক্য রয়েছে। আজ থেকে বিশ-পঁচিশ বছর আগেও শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানোতে ‘সহায়তা করা’ বা কোন কিছুর বিনিময় ছাড়াই শিক্ষার্থীদের ‘পড়া দেখিয়ে দেয়ার’ প্রবণতাটা বেশি ছিল। সেখানে বর্তমানে প্রাইভেট পড়া বা পড়ানো পুরোপুরিই ব্যবসায়িক উদ্যোগ, অর্থের বিনিময়ে পড়া তৈরি করে দেয়াটাই এক্ষেত্রে মুখ্য। এমনও দেখা যায়, একজন শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ের বেতন, পরীক্ষা-ফি ও বই-খাতা-কলম ইত্যাদিতে মাসে যত খরচ করছে, তার চেয়েও বেশি খরচ করছে প্রাইভেট শিক্ষকের পেছন। প্রাইভেট পড়ার ফলে কিছু শিক্ষার্থী হয়তো ভালো ফলাফল করছে; কিন্তু এতে লেখাপড়ার সার্বিক মান প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে; প্রশ্নের সম্মুখীন প্রচলিত স্কুল-সিস্টেমও।
প্রাইভেট পড়া বা পড়ানো খারাপ কিনা– অনেকে সে প্রশ্ন করেন। অনেকে প্রাইভেট টিউশনির পক্ষে, অধিকাংশই বিপক্ষে। যারা বিপক্ষে তাদের যুক্তি হচ্ছে, প্রাইভেট টিউশনি ক্ষতিকর। এতে প্রচুর অর্থ খরচ ও সময় নষ্ট হয়, প্রাইভেট পড়ার ফলে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে পড়ার প্রতি আগ্রহী হয় না, শিক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে ইত্যাদি। যারা পক্ষে তাদের যুক্তি হচ্ছে, বিদ্যালয়ে যথাযথ পড়ালেখা হয় না বলেই শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতে হয়। তাছাড়া কোন অভিভাবক বিদ্যালয়ের পড়ালেখার বাইরে সন্তানকে আরও বেশি পড়াতে চাইতে পারেনই। যার সামর্থ্য আছে, তিনি চাইবেন তার সন্তান অন্যদের চেয়ে এগিয়ে যাক। শিক্ষা যেহেতু এখন ‘পণ্যে’র কাতারে এবং শিক্ষার খরচকে সময়ের ‘শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ’ বলে মনে করা হয়, সেখানে যার সামর্থ্য আছে তিনি তো সে সামর্থ্যরে প্রতিফলন ঘটাবেনই। বর্তমান বৈষম্যমূলক সমাজ-রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেহেতু ‘ফ্রিডম অব চয়েজ’ রয়েছে, সে ক্ষেত্রে একজন অভিভাবকের অধিকার রয়েছে বিদ্যালয়ের পড়ালেখার বাইরেও সন্তানকে ‘বেটার ট্রিটমেন্ট’ দেয়ার। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, যাদের সামর্থ্য নেই তাদের কী হবে? আর এতে কি বিদ্যালয়-ব্যবস্থা আস্তে-আস্তে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে?
বিজ্ঞান শিক্ষায় আমাদের পশ্চাৎপদতা
স্কুল-কলেজ পর্যায়ে আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষার অবস্থা খুব খারাপ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোন কার্যকরী ব্যবস্থা এখনো নেয়া হচ্ছে না। শহর পর্যায়ে বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখনো হতাশাজনক না হলেও গ্রাম-পর্যায়ের স্কুল কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে কমে যাচ্ছে। তার মানে আগামী দশ বছর পরে বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকেরও অভাব দেখা দেবে। ইউনিভার্সিটি পর্যায়েও এখন মৌলিক বিজ্ঞান বিষয়ের কোন কদর নেই।
নামী-দামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য অভিভাবকদের প্রাণান্তকর চেষ্টা
শহরের নামী স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য কত হাজার টাকার ব্যবসা চলছে তার যদি সঠিক পরিসংখ্যান থাকতো – আমরা দেখতে পেতাম – ভর্তি বাণিজ্যে এখন কত লাভ! অভিভাবকরা ভর্তি-বণিকদের হাতে জিম্মি। ভালো স্কুলে ভর্তি করাতে পারলে ছেলে-মেয়ে ভাল পড়াশোনা শিখবে – এটাই যে প্রধান লক্ষ্য তা বলা যাবে না। তথাকথিত ভালো স্কুলগুলো ঠিক কোন মাপকাঠিতে ভাল তার কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম আমাদের জানা নেই। হয়তো বিশাল বিশাল বিজ্ঞাপন আর প্রচারের কল্যাণে।
শহর ও গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য
বছর দশেক আগেও দেখা যেতো একদম প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুল কলেজ থেকেও কোন না কোন শিক্ষার্থী জাতীয় পর্যায়ের মেধাতালিকায় স্থান পাচ্ছে। এখন সে সংখ্যা কমতে কমতে একেবারে শূন্যের কোঠায় এসে পৌছেছে। এখন গ্রামের স্কুল-কলেজগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। গ্রামেও যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা সামান্য ভালো – তারা তাদের ছেলেমেয়েদের শহরের স্কুলে লেখাপড়া করানোর চেষ্টা করেন। আর শহরের অলিতে গলিতে এখন ইংরেজি বাংলা মেশানো নানারকম নামের নানারকম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একই বাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়, কমিউনিটি সেন্টার, সেলুন, সুপারমার্কেট সব একসাথে দেখা যায়। প্রচুর উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়ে এখন সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হচ্ছেন – কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার মান একটুও বাড়ছে না।
গ্রেডিং পদ্ধতি
গ্রেডিং পদ্ধতিকে ভালো পদ্ধতি বলে মনে করি। আগের মেধাতালিকার যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা ছিল তার চেয়ে গ্রেডিং পদ্ধতি অনেক ভালো। এ পদ্ধতির ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো আস্তে আস্তে কমে আসছে। কিন্তু রেজাল্টের পদ্ধতির চেয়েও বেশি জরুরি হলো আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতির উন্নয়ন করা। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু হলে একটা বিরাট গুণগত উত্তরণ ঘটবে বলে আমি মনে করি।
এক্সট্রা-কারিকুলার এক্টিভিটিজের অভাব
বাংলাদেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের – বিশেষ করে শহর অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার পেছনে যত সময় ব্যয় করে তা উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের শিক্ষার্থীর চেয়ে অনেক বেশি। একবার স্কুল-কলেজের ক্লাস করে প্রায় প্রত্যেকেই আবার কোচিং সেন্টারে যায়। সেখানে এক্সট্রা -কারিকুলার কিছু করার সময় কোথায়? তারপরও যে শিক্ষার্থীরা যে সাংস্কৃতিক চর্চা করে, ছবি আঁকে তাতেই তো অবাক হতে হয়।
শিক্ষক সমাজের মধ্যে পেশার প্রতি অনীহা
বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন খুব কম। গ্রামের শিক্ষকদের অবস্থা আসলেই খুব খারাপ। কিন্তু শহরের নামী কোন স্কুল-কলেজের শিক্ষক হতে পারলে – এবং নীতি বিসর্জন দিয়ে সুযোগের সদ্ব্যাবহার করতে জানলে শিক্ষকদের পক্ষে মাসে লাখ টাকা উপার্জন করা এখন কোন ব্যাপারই নয়। কিন্তু তারপরও শিক্ষকতা পেশায় কেউ আসতে চান না। সে কারণেই দেখা যায় – বিসিএস পরীক্ষায় শিক্ষকতার অপশানের চেয়ে পুলিশের বা কাস্টমসের চাহিদা কয়েকশ গুণ বেশি। এর কারণ বাংলাদেশের নিরিখে আমরা সবাই জানি।
বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি
ব্যবসায়ীরা যখন স্কুল-কলেজ খোলেন তখন তা তাদের অন্য ব্যবসার মত হবে এটাই তো স্বাভাবিক। তবে আমরা তাদের গালাগালি করি ঠিকই- আবার আমরাই টাকার লোভে ছুটে যাই সেসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কিছু দাক্ষিণ্য পেতে। বাংলাদেশে এখন অনেক বেসরকারী মেডিকেল কলেজ। সেখানে সরকারী মেডিকেল কলেজের অধ্যাপকরা ঘন্টায় দশহাজার টাকা সম্মানী (আসলে পারিশ্রমিক) নিয়ে ক্লাস নিতে যান। তো এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি এক ধরণের মমত্ববোধ তো তৈরি হয়েই যায়। এখন বেসরকারী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে শুরু করে কী নেই! কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই তো টাকার বিনিময়ে ডিগ্রি বেচে।
বাংলা মিডিয়াম, ইংলিশ মিডিয়াম আর মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্য
তিন মিডিয়ার বৈষম্য আছে এটা সবাই জানেন। ইংলিশ মিডিয়াম মাদ্রাসাও আছে এখন। মিঃ অধিকারী ‘ও লেভেল’ ‘এ লেভেল’ বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে, আবার দেশীয় সিলেবাসের ইংরেজি মিডিয়াম রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। এ ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না আমি। আরো একটি পদ্ধতি আমাদের দেশে চালু আছে – ক্যাডেট কলেজ পদ্ধতি। কয়েক বছর আগেও সেখানে বাংলা মিডিয়াম চলতো। এখন ক্যাডেট কলেজগুলোতে নাকি বাংলায় কথা বলতেও নিরুৎসাহিত করা হয়। আমি ঠিক জানি না এভাবে ইংরেজি শেখা যায় কিনা, বা গেলেও সেটা কী কাজে লাগে। আর মাদ্রাসা শিক্ষা আমাদের মত দেশের কোন উৎপাদনশীল খাতকে উন্নত করছে কি না। আমাদের দরকার প্রচুর কারিগরী শিক্ষা, দক্ষ প্রযুক্তির শ্রমিক তৈরির প্রতিষ্ঠান।
শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতি
আমাদের দেশের কোন নিয়োগ পদ্ধতিই প্রশ্নাতীত নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের যে পদ্ধতি প্রচলিত আছে তা লজ্জাজনক। এই সিস্টেমের যারা শিকার হয়েছেন তারা জানেন কতটা অপমানজনক অসমপ্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয় অনেক যোগ্য ও মেধাবী মানুষকে যাদের মেধা ছাড়া আর কোন সম্বল নেই। বিসিএস পরীক্ষায় দুর্নীতি তো ওপেন সিক্রেট। দেখা যায় দুর্নীতি যারা করেন তাদের কিছুই হয় না – অথচ দুর্নীতির যারা শিকার তাদেরই কষ্ট পেতে হয় পদে পদে। ২৭ তম বিসিএস এর দুর্নীতির রেশ এখনো পুরোপুরি কাটেনি।
শিশুদের দেরিতে ভর্তি ও আগাম ঝরে পড়া
সাধারণভাবে, অন্যান্য অঞ্চলের শিশুদের তুলনায় শিশুরা স্কুলে ভর্তি হয় দেরিতে, আবার আগাম ঝরে পড়ার হারও তাদের মধ্যে বেশি। বয়সভিত্তিক নিট ভর্তি হারের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, প্রতিটি বয়স গ্র“পের শিশুদের নিট ভর্তি হার এ সংক্রান্ত জাতীয় গড় হারের চেয়ে কম। যেখানে বাংলাদেশের ছয় বছর বয়সী শিশুদের ৬৫% স্কুলে ভর্তি হয় সেখানে একই বয়সী শিশুদের মধ্যে এই হার পাওয়া গেছে মাত্র ৫২%। অভিভাবকদের একটি অংশ বলেছেন যে, শিশুদের স্কুলে ভর্তি করানোর বয়স সম্পর্কে তারা অবহিত নন। আর একটি অংশ ভর্তি না করানোর কোনো অজুহাত দেখাতে পারেননি। অবশ্য এটাও জানা গেছে যে, উক্ত বয়সী শিশুদের একটি অংশকে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভর্তি করায়নি, যদিও মা-বাবারা তাদের স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। শিশুর বয়স ১৫ বছর হতেই সমতল ভূমির অর্ধেক শিশু, হাওর অঞ্চলের ৬০% শিশু এবং চা-বাগান, পাহাড় ও বনভূমির ৭৩% শিশু বিদ্যালয়-বহির্ভূত শিশুতে পরিণত হয়। এ সংক্রান্ত তুলনামূলক জাতীয় হার ৪০%-এরও নিচে। ঝরে পড়া শিশুদের একটি অংশের পরিবারগুলো পড়ালেখার ব্যয়ভার বহন করতে নিতান্তই অপারগ আর অন্যরা অল্প বয়সেই আয়-উপার্জনের জন্য নানা ধরনের কাজে যোগ দেয়। বিদ্যালয়ে শিক্ষণ-শিখনের দুর্বল মান, শেখানোর ক্ষেত্রে যতেœর অভাব শিক্ষার্থীদের ঝওে পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে।
ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা
বিদ্যালয় পরিচালনার মৌলিক বিষয়সমূহ যথাযথভাবে প্রতিপালনের ব্যাপারে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি এবং উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের কর্মোদ্যোগ খুব কমই লক্ষ করা গেছে। বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গত এক বছরে একবারও পরিদর্শন করা হয়নি। আবার বেশ ক’টি মাত্র এক বা দুই বার পরিদর্শন করা হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। উপজেলা রিসোর্স সেন্টার থেকে পরিদর্শনের ক্ষেত্রেও ব্যাপক দুর্বলতা পাওয়া গেছে। প্রায় ৭৩% প্রাথমিক বিদ্যালয় এক বছরে (২০০৯ সালে) একবারও পরিদর্শন করা হয়নি। বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভার বিবরণী পর্যালোচনা করে শিক্ষকদের সময়ানুবর্তিতার অভাবের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের কার্যতালিকায় বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে কিন্তু এ নিয়ে তারা কোনো কাজ করেছেন বা কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে মনে হয়নি। বিদ্যালয় পরিদর্শন সাধারণভাবে খুবই সাধামাটাভাবে করা হয়ে থাকে। পরিদর্শনকালে যা আলোচনা হয় সেগুলো সরাসরি শিক্ষার মানোন্নয়নের সমস্যা বা সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের পথ অনুসন্ধানের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মকর্তার অভাব একটা বড় কারণ হিসেবে বের হয়ে এসেছে।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সমস্যার সমাধান সমূহ
১৯৭১ সালে বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নেয়া আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর দুর্যোগের সাথে সংগ্রাম করছে প্রতিনিয়ত, কিন্তু বর্তমানে যে ব্যাধিটি সংগ্রামের মাত্রা তীব্রতর করছে তা হল দুর্নীতি। দুর্নীতির মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা আজ ভুলুন্ঠিত হচ্ছে। পরপর তিনবার নির্লজ্জ জাতি হিসেবে চ্যাম্পিয়ন হয়ে সর্বশেষ টিআই রিপোর্টে আমাদের অর্জন ত্রয়োদশ স্থান। বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আমাদের অবস্থান বদলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। খুব সহজেই অনুমেয়, কর্মের ফলস্বরূপ আমাদের এই কীর্তি অর্জন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য- একটি দেশের কাণ্ডারির ভূমিকায় এদেরকেই অবতীর্ণ হতে হয়। শুধু দরকার যোগ্য, সৎ, দেশপ্রেমিক দক্ষ নেতা- যে জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় (দক্ষ নেতৃত্ব) সকল কালিমা দূর করে দেশকে এনে দিবে থালা ভরা সম্মান। এছাড়াও আগামী প্রজন্মকে হতে হবে দক্ষ ও দেশপ্রেমিক। এক্ষেত্রে দরকার শুধু সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা।
একটি জাতির মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে শিক্ষার (সাক্ষরতা) হার উন্নত হতে হয় তা অনেক আগেই প্রমাণিত হয়েছে। এ প্রয়োজনীয়তা থেকে প্রত্যেকটি দেশ শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে এটিই স্বাভাবিক। আমাদের দেশেও এই ধারাটি প্রচলিত। ধারাটি প্রচলিত হলেও এর ফল কতটুকু তা নিয়ে আমাদের সন্দেহ থাকলেও একেবারেই যে উন্নতি হচ্ছে না তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কতটুকু? দুর্নীতির মহোৎসব শিক্ষা খাতকে এমনভাবে আকড়ে ধরেছে যে দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত খাতগুলোর মধ্যে শিক্ষা খাতের অবস্থান বিগত বছরগুলোতে প্রথম হলেও বর্তমানে তৃতীয়।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন
শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন কমিটি-উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। উচ্চবিদ্যালয়সমূহে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণী সংযোজিত হবে। নিম্ন মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়কে একীভূত করা হবে, তারপর ক্রমান্বয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত চালু করা হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই যে পরিবর্তন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত এবং উচ্চবিদ্যালয়সমূহকে একাদশ-দ্বাদশ, তারপর একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর কলেজগুলোতেও পরিবর্তন। প্রায় ৭০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৫ হাজার উচ্চমাধ্যমিক এবং দুই হাজার কলেজে ভৌত অবকাঠামোর পরিবর্তন ও উন্নয়ন নিঃসন্দেহে আমাদের দুর্বল অর্থনীতির জন্য সুকঠিন কাজ। এখানে সম্পদের যে অপচয় হবে, তাও ভেবে দেখার বিষয়। আমরা জানি যে কোনো উন্নয়ন বাজেটের সদ্ব্যবহার করাও সহজ নয়—সকল স্তরেই লাইন লস হবে। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে স্থাপিত ভৌত অবকাঠামোর শতভাগ ব্যবহার আমাদের জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহে যে পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে, এতে নিঃসন্দেহে অনেক সমস্যারও সৃষ্টি হবে। যেমন উচ্চবিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষক ষষ্ঠ-অষ্টম শ্রেণীতে পড়াতেন, তাঁদের কী হবে; কলেজে যাঁরা উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীতে শিক্ষকতা করতেন, তাঁদের কীভাবে ব্যবহার করা যাবে। ভৌত অবকাঠামো, গবেষণাগার, তার ব্যবহার কীভাবে নিশ্চিত হবে? এসব জটিলতার দিকে না গিয়ে বরং বিদ্যালয়সমূহে যেসব শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে, তা-ই রাখা হোক। বরং শিক্ষানীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ সমৃদ্ধি ঘটানো হোক গ্রন্থাগার কিংবা পরীক্ষাগারে, শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত উন্নয়নে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে।
শিক্ষার যথাযথ পদ্ধতি ব্যবহার
ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রত্যয়কে মনে রেখে প্রতিটি পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সারা দেশের ছাত্রছাত্রীদের সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা উচিত। পাঠ্যপুস্তকের মানে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে ভাবার কোনো কারণ নেই। ভালো ভালো পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে আমাদের বিনিয়োগ ঘটানো অত্যন্ত জরুরি। এখনো সরকারি স্কুল-কলেজে পর্যাপ্তসংখ্যক যোগ্য শিক্ষকের অভাব রয়েছে। এরও অবসান চাই।
আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শিক্ষায় বড় বিনিয়োগ ঘটাতে পারব না। আমাদের তরুণ ছেলেমেয়েদের অফুরন্ত প্রাণশক্তিকে শিক্ষা ও দক্ষতার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে উদ্বুদ্ধ করার জন্য শিক্ষার সকল পর্যায়ে অলিম্পিয়াডের মতো প্রতিযোগিতা চালু করা উচিত। যেকোনো বিষয়ে উৎকর্ষ অর্জনের জন্য প্রতিযোগিতার থেকে অধিক ব্যয়সাশ্রয়ী কোনো পদ্ধতি নেই। সুতরাং আমাদের তরুণদের প্রাণশক্তিকে ব্যবহারের জন্য, সুপ্তশক্তিকে জাগ্রত করতে জনপ্রিয় প্রতিযোগিতার আয়োজন ও তার বহুল প্রচারে সারা দেশের মানুষকে আগ্রহী করা উচিত।
মুখস্থনির্ভর পরীক্ষার ফলে আমাদের ছেলেমেয়েদের সৃজনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে, এ কথাটি প্রায় সবাই বিশ্বাস করে। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এবং তার মূল্যায়নকে খুব গুরুত্ব দিতে হবে। এর জন্য একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান গড়া যেতে পারে, যা সারা বছর পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মূল্যায়ন নিয়ে গবেষণা করবে। প্রতিবছরই ছাত্রদের সৃজনশীল প্রশ্ন ও সমস্যা দিয়ে তাদের সমাধানের দক্ষতা বৃদ্ধিতে উদ্বুদ্ধ করবে।
বিগত কয়েক বছর বোর্ড কর্তৃক এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার যে ফলাফল প্রকাশিত হচ্ছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগের। ৭০-৮০ হাজার ছাত্র যদি পারফেক্ট জিপিএ নিয়ে পাস করে তার অর্থ হলো ৭০-৮০ হাজার ছাত্রের মধ্যে জ্ঞানের ব্যবধান বর্তমান মূল্যায়ন পদ্ধতি নির্ণয় করতে পারে না। ছাত্রদের প্রাণশক্তি অফুরন্ত আরও কঠিন সমস্যা দিয়ে তাদের চ্যালেঞ্জ করতে হবে। নিশ্চয়ই সেসব সমস্যাও তারা সমাধান করতে পারবে।
বোর্ডের পরীক্ষার পাশাপাশি নিয়মিতভাবে অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি অত্যন্ত জরুরি। ভারতে টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ এই দায়িত্ব পালন করছে। আমাদেরও অনুরূপ প্রতিষ্ঠান গড়া দরকার।
কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা
চলিত শিক্ষা পদ্ধতিতে গ্রামে ও শহরে বসবাসরত গরীব জনগোষ্ঠির ছেলে মেয়েরা স্কুলে আসতে চায় না , কারণ স্কুলে সনাতন পদ্ধতিতে সামান্য লেখাপড়া করে তারা পায় না কোন চাকুরী, পারেনা অন্য কোন উপার্জন কারী কাজ করতে। অযথা কয়েক বৎসর সময় তাদের কাছ থেকে চলে যায় তখন তারা নিজের জীবন নিয়ে নিজেরা বেসামাল হয়ে পড়ে। গরীব পিতা-মাতা তাদের ছেলে মেয়েদের নিয়ে অস্থির হয়ে যায়। স্কুল পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষার প্রচলন হলে গরীব জনগোষ্ঠির ছেলে মেয়েরা স্বতস্ফূর্তভাবে স্কুলে আসবে পড়া লেখার পাশাপাশি কারিগরি কাজ শিখবে ও আত্মকর্মসংস্থানের দিকে নিজেকে নিয়োগ করবে। শিক্ষার ব্যাপকতার বিস্তারের ফলাফল হিসেবে নিম্মবিত্ত জনগোষ্ঠির মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা ও হ্রাস পাবে।
প্রচলিত শিক্ষায় পাস পাওয়াদেরকে অনেকে সংবর্ধনা দেয়, পুরস্কার দেয়া হয়। বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করে কিন্তু যারা রেজাল্ট খারাপ করেছে বা পাশ করতে পারেনি সেই বৃহৎ অংশের মঙ্গলের জন্য কোনো উদ্যোগ নেই। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, ঝরে পড়া বা অনগ্রসর বিপুল ছাত্রছাত্রী পরিবারের কাছে হয়ে পড়ে বোঝার মত। অবহেলিত এই বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী একসময় সমাজের অন্ধকার জগতের দিকে পা বাড়ায়। নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। সমাজের শান্তিশৃংখলার বিঘ্ন ঘটায়। অথচ এই ঝরে পড়া, পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের কোন বৃত্তিমূলক ট্রেনিং বা কারিগরি শিক্ষাথাকলে তারা নিজেদের পছন্দমত পেশা বেছে নিয়ে সুন্দর জীবন যাপন করতে পারতো।
বৃহৎ জনগোষ্ঠিকে দক্ষ জনগোষ্ঠি হিসেবে গড়ে তোলা
প্রথাগত শিক্ষা কেবল শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই বাড়াচ্ছে। যদি আনুষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে আমার বিশ্বাস দেশে স্কুলগামী কোনো ছেলেমেয়েই বেকার থাকবে না। যারা ভালো রেজাল্ট করবে তাদের জন্য উচ্চ শিক্ষার পথ উম্মুক্ত কিন্তু যারা পিছিয়ে পড়ে বা পড়া লেখায় অনগ্রসর তাদেরকে কারিগরি বা বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ জনগোষ্ঠি হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। তাই আমাদের দেশের স্কুল/মাদ্রাসাগুলোতে প্রচলিত পাঠ্যসূচির পাশাপাশি ৭ম শ্রেনী থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত বৃত্তিমূলক বিভিন্ন ট্রেড চালু করা আবশ্যক। আমাদের সমাজে যে ক্ষেত্রে দক্ষ জনগোষ্ঠি দরকার প্রচলিত শিক্ষা সেরকম দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারছে না। যার ফলে শিতি /অর্ধশিতি বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলছে। শিক্ষার উদ্দেশ্য মানুষকে বিকশিত করা, দক্ষ মানব সম্পদে রুপান্তরিত করা। কিন্তু প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা তা করতে অনেকাংশে অসফল। আমার বিশ্বাস ৭ম থেকে ১০ম শ্রেণীতে বৃত্তিমূলক ট্রেড,ও কারিগরি শিক্ষা চালু করলে এদেশে একজন ছেলে-মেয়েও বেকার থাকবেনা এবং স্কুলে যাওয়ার উপযুক্ত সকল ছেলে-মেয়ে স্বেচ্ছায় স্কুলে যাবে। এর জন্য বাড়তি কোনো খরচেরও প্রয়োজন হবে না। হেডমাস্টার, দায়িত্ববান শিক, শিক্ষানুরাগী, বিদ্যোৎসাহীদের সহযোগীতায় প্রতিটি মাধ্যমিক স্কুলে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা প্রচলন করা সম্ভব।৭ম থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত টেকনিক্যাল শিক্ষার ব্যবস্থা করা অধিক যুক্তিযুক্ত হবে।
কেননা-
*শিক্ষার অধিক বিস্তারের অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হিসেবে জনসংখ্যা অত্যাধিক বৃদ্ধির হার ও কমানো সম্ভব।
* অশিক্ষিত লোককে সামান্য নগদ ঋণ বিতরণ না করে তাকে কারিগরি শিক্ষা প্রদান করলে সে নিজে নিজের কর্মসংস্থান করে নিতে পারবে।
* কারিগরি শিক্ষা স্কুল পর্যায়ে প্রদান করলে তারা সহজে যেমন বেকারত্বের হাত থেকে মুক্তি পাবে তেমনি দেশে বিপুল সংখ্যক বেকারের কর্মসংস্থান হবে।
* বিদেশে যাওয়ার সময় মধ্যসত্বভোগীদের হাতে পড়ে, অশিক্ষিত ও অদক্ষ লোক যেমন প্রতারিত হচ্ছে তেমনি বিদেশ থেকে সর্বস্ব হারিয়ে ফেরত আসছে। কারিগরী শিক্ষা তা রোধে অবদান রাখবে।
যে ভাবে ইলেকট্রনিক পণ্য বাংলাদেশের সকল গ্রামে গঞ্জে ব্যবহার হচ্ছে, উক্ত পণ্যগুলি গ্রামে নষ্ট হলে মেরামতের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক কারিগর নেই। এ শিক্ষা প্রচলনের মাধ্যমে গ্রাম পর্যায়েও কর্মসংস্থান সম্ভব হবে। রোধ হবে শহর মুখী জনস্রোত।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে রাজনীতির উর্ধ্বে রাখা
রাজণীতি শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষার পরিবেশকে করেছে কুলশিত। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার ভিত্তিটি নড়বড়ে করে দেয়, শিক্ষাঙ্গনের রাজনীতি। কত মেধাবী প্রাণ ঝড়ে যায় অসময়ে আর রাজনীতির কালো থাবার কারণন। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ছাত্র শিক্ষক উভয়েই রাজনীতির পথে তাদের বিচরণ অভ্যাহত রাখছে। তাতে করে দেশের শিক্ষার মান, মর্যাদা, উন্নয়ন, পরিকল্পনা সব কিছুই হারিয়ে যায়। সরকার ইচ্ছা করলেই দেশের শিক্ষাঙ্গণ থেকে রাজনীতির ভয়াল বিচরণ বন্ধ করতে পারেন। তাতে শিক্ষার গুণগত মান পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো কিছুটা হলেও উন্নতি করা সম্ভব হবে।
ছাত্র রাজনীতি বন্ধ বা কন্ট্রোল
ছাত্র রাজনীতির পক্ষে যারা যুক্তি দেখাচ্ছেন, তারা আরো বলছেন – ছাত্র রাজনীতির কারনেই সম্ভব হয়েছিল ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের নীল নক্সা প্রতিরোধ করা। বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে সফলতা অর্জন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভ। ১৯৯১ সালে স্বৈরাচার সরকারের উৎখাত ঘটানো, ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবে ঐ দিনগুলোর ছাত্র রাজনীতি দলীয় রাজনীতির বিষাক্ত ছোয়ায় বিষাক্ত ছিলনা। ঐ দিনগুলোতে ছাত্র রাজনীতি ছিল জাতীয় ছাত্র রাজনীতি। যা ছিল ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে জাতীয় এবং জীবন মরনের সাথে সর্ম্পকিত। যা ছিল বিবেকের ধ্বংশনের প্রতিক্রিয়া বা প্রতিফলন। আর তাই বর্তমানের দলীয় ছাত্র রাজনীতির চেয়ে অতীতের জাতীয় ছাত্র রাজনীতির ভুমিকা ছিল খুবই জুড়ালো এবং সফলতার উজ্জ্বল্যে ভাস্বর ও চিরস্মরনীয়।
বর্তমানে ছাত্র রাজনীতি মানেই হল দখল, টেন্ডার চিন্তাই, দলীয় সংঘাত, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি। কাজেই পবিত্র ছাত্র রাজনীতিকে দলীয় সংঘাতের বা ক্ষমতায় টিকে থাকার রাজনীতি দিয়ে আর কলংকিত করা যায় না।
কেউ কেউ আরো বলছেন, ছাত্রদের লেখা-পড়ার পাশাপশি রাজনীতিও তাদের মৌলিক অধিকার। কিন্তু আমরা বলব দলীয় রাজনীতির নামে বর্তমান ধারায় প্রচলিত ছাত্র রাজনীতি কখনও ছাত্রদের মৌলিক অধিকার হতে পারে না।
ছাত্রদের মৌলিক অধিকার রাজনীতি। এ ক্ষেত্রে অর্থাৎ এই ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্র হতে পারে, যেমন- লেখা পড়ার সঙ্গে জড়তি সকল কিছু সুষ্ঠু ও সঠিক ভাবে ছাত্র ছাত্রীদরে প্রাপ্য নশ্চিতি করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য অগ্রণী ভুমিকা পালন করা। জাতীয় ইস্যুতে, যেমন – সবার জন্য খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের সমস্যা দূরীকরণে সরকারকে সহযোগীতা প্রদানের মাধ্যমে সকল নাগরিকের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করা।
ছাত্র রাজনীতি হবে সুশৃংখল। যা হতে পারে তার লেখা পড়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা সমধানের অন্যতম হাতিয়ার। ছাত্র রাজনীতি হবে জাতীর ক্রান্তি লগ্নে এক অনন্য সত্ত্বা যার কোন বিকল্প নাই। অতীতে জাতীর ক্রান্তি লগ্নে ছাত্র রাজনীতি ছিল উল্লেখ যোগ্য ভাবে প্রশংসনীয়। ছাত্র রাজনীতির সেই ঐতিহ্যগত সুনাম ও সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ ফিরে পেতে দলীয় রাজনীতি নামের ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
বর্তমান প্রজন্মকে সুস্থ ও সুন্দর শিক্ষার পরিবেশ উপহার দিতে হলে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কোন বিকল্প নাই।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্ব-মূল্যায়ন
সম্প্রতি দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর স্ব-মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সরকার। বাংলাদেশে এ ধরনের মূল্যায়ন নতুন হলেও বিশ্বব্যাপি বেশ পুরনো। এ নিয়ে যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পিটার রাড এবং ডেভোরা ডেভিস’ নামে দুই ভদ্রলোকের গবেষণা প্রকাশ হয় ২০০০ সালে। তারা মূল্যায়নের শুরু হিসেবে ১৯৯০ সালকে আবিষ্কার করেছেন। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার গুনগত মান উন্নয়ন। উন্নত বিশ্বে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে শিক্ষার স্থানীয় কর্তৃপক্ষ (local education authority) কর্তৃক এ মূল্যায়ন পরিচালনা করা হয়। বাংলাদেশে শিক্ষার এরকম স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নেই বলে কেন্দ্রীয়ভাবে এই মূল্যায়ন করা হয়েছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর-এর সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (এসইএসডিপি) আওতায় ১৭ হাজার ৮৭৩টি বিদ্যালয়ের মধ্যে এ মূল্যায়ন হয়। ব্যানবেইজের সর্বশেষ ২০০৯-এর তথ্যানুসারে বাংলাদেশে সরকারি এবং বেসরকারি মিলিয়ে মোট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৯ হাজার ৮৩। মূল্যায়ন বিষয়ে বিস্তর আলোচনার সুবিধার্থে মূল বিষয়গুলো জানা যাক। ‘১৪ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষামান উন্নত’ শিরোনামে ১০ অক্টোবর পত্রিকাগুলো প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যা বলছে ‘পারফরম্যান্স বেজড ম্যানেজমেন্ট (পিবিএম)’ পদ্ধতিতে বিদ্যালয়গুলোর মান যাচাই এবং ক্রমোন্নতি পরিমাপের জন্য সাতটি সূচকের অধীনে মোট ৪৫টি উপ-সূচকের ভিত্তিতে এ মূল্যায়ন করা হয় ।
প্রাথমিকেও হতে হবে স্ব-মূল্যায়ন
স্ব-মূল্যায়ন প্রাথমিক শিক্ষায়ও দরকার। প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে না হলেও এ শিক্ষার অবস্থা দেখার জন্য মূল্যায়ন আবশ্যক। বিশেষ করে কতটা শোচনীয় অবস্থা আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার তা স্ব-মূল্যায়ন ছাড়া পরিমাপ করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয় সংখ্যা ৮১ হাজার ৫০৮ টি (ব্যনবেইজ ২০০৯)। এর মধ্যে সরকারি ৩৭ হাজার ৬৭২টি। রাষ্ট্র যেহেতু প্রাথমিকের দায়িত্ব নিয়েছে, তা কতটা ঠিক মতো হচ্ছে তার জন্য গবেষণার, মূল্যায়নের আবশ্যকতা রয়েছে। আমাদের এরকম ভালো ভালো উদ্যোগ খুব কম নেয়া হচ্ছে তা নয়, কিন্তু সকল উদ্যোগই ভেস্তে যায় বা সফলতার মুখ দেখতে পারে না সরকারের গাফলতি, দুর্নীতি, অদক্ষতা ইত্যাদি নানা কারণে। যে অভিযোগটা এ মূল্যায়নকেও ছাড়েনি। ভবিষ্যতে মাধ্যমিকের মত প্রাথমিক স্তরেও স্বচ্ছভাবে এ মূল্যায়ন হবে, এ আশা সবাই করতেই পারে।
উৎপাদন ও কর্মমুখী কারিকুলামেই অগ্রগতি
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে সম্প্রতি। কৃতকার্য ছেলেমেয়েদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ_ প্রত্যাশিত বিষয় ও পছন্দের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ আশ্বাস দিয়েছেন, সারাদেশে কলেজগুলোর যে ধারণ ক্ষমতা আছে তাতে আসন সংকট হবে না; তবে ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা হবে। আমরাও ধরে নিচ্ছি, কৃতকার্য শিক্ষার্থীরা কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবে। তবে দেখা যাবে_ যে ডাক্তারি পড়তে চাইছে তাকে ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা যে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাইছে তাকে হয়তো পদার্থ বা রসায়ন বিজ্ঞানে ভর্তি হতে হবে। এমনকি ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছা আছে, এমন শিক্ষার্থীকে হয়তো ইতিহাস বা সাহিত্যে পড়তে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর নিজস্ব পছন্দ বা প্রত্যাশার মূল্য সামান্যই। এটি শিক্ষা ব্যবস্থার সংকট। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক অদ্ভুত নিয়ম চালু করেছে। সেটি হলো অনুষদ বা ফ্যাকাল্টিই নম্বর অনুসারে শিক্ষার্থীর জন্য বিষয় ঠিক করে দিচ্ছে। হয়তো একজন শিক্ষার্থী ইংরেজি সাহিত্যে পড়তে চাইল, কিন্তু বাস্তবে তাকে পালি কিংবা ইতিহাসে পড়তে হয়। নম্বরই এখানে মুখ্য। এই নম্বরের কারণে বিজ্ঞান ফ্যাকাল্টির কোনো ছাত্রকে কলা কিংবা সোশ্যাল সায়েন্সে আসতে হচ্ছে।
পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার এই হকিকত জানেন না তাদের মনে হতে পারে, অধিক মাত্রায় পরিকল্পিত ব্যবস্থার কারণে এটি হচ্ছে। কিন্তু আসল সত্য হচ্ছে, এখানে শিক্ষার সঙ্গে কর্মযোগের বিষয়টি একেবারেই গৌণ। সাহিত্য বা বিজ্ঞানে ডিগ্রি নিয়ে ব্যাংকের হিসাবরক্ষক হতে হয়েছে, এমন উদাহরণ অনেক। অথচ এ কাজের জন্য প্রয়োজন ছিল হিসাববিজ্ঞানের ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা। একইভাবে নাট্যতত্ত্ব বা সঙ্গীতের ডিগ্রিধারীদের শিল্পকলা একাডেমী বা সংশ্লিষ্ট পেশায় চাকরি হচ্ছে না। পুরাতত্ত্ব বিভাগের ছাত্রদের পুরাতত্ত্ব অধিদফতর বা জাদুঘরগুলোতে চাকরি হচ্ছে না। কাউকে কাউকে এমবিবিএস পাস করে ম্যাজিস্ট্রেট হতে দেখেছি। মানুষের পেশা পরিবর্তনের অধিকার আছে। কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ পেশায় কাজ করার মধ্য দিয়ে যে অধিকতর যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখা সম্ভব, অন্য বিষয়ে ডিগ্রিধারীদের দিয়ে সে কাজ করানো দুরূহ। শিক্ষাঙ্গনের অভিজ্ঞতা অনুসারে পেশা চয়নের সুযোগ নেই। এ কারণে সর্বক্ষেত্রেই রয়েছে এক ধরনের হাতুড়েপনা। এ হাতুড়েপনায় আমাদের জাতীয় উন্নয়নের ধারা হচ্ছে বাধাগ্রস্ত, কর্মশক্তির হচ্ছে অপচয়।
মাদ্রাসা শিক্ষা প্রয়োজন আমূল পরিবর্তন
বাংলাদেশের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। নিজেদের রাষ্ট্র পরিচালনা, রাষ্ট্রের উন্নয়ন, জাতির কল্যাণ ও আত্ম নির্ভরশীলতা অর্জনের দায় দায়িত্ব নিজেদের উপর। নিজেদের জাতিকে উন্নত করে গড়ে তোলা এবং বিশ্বের দরবারে নিজেদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব নিজেদের। বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। এখানকার শতকরা পঁচাশিভাব নাগরিক মুসলাম। এখানকার মানুষ অত্যন্ত ইসলাম প্রিয়, আল্লাহভক্ত ও ধর্মভীরু। অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ পিছে পড়ে আছে। জনসংখ্যার তুলনায় আমাদের সম্পদ কম। আমাদের জনশক্তিকে সম্পদে পরিণত করার মধ্যেই আমাদের কল্যাণ নিহিত রয়েছে। মুসলিম হিসেবে আমাদের আছে গৌরবান্বিত ইতিহাস। আছে মহান ঐতিহ্য। এক উন্নত অনুপম ইতিহাস ও সংস্কৃতির অধিকারী জাতি আমরা। আমাদের আছে একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা। আমাদের কাছে আছে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন দর্শন ও জীবন বিধান। আমাদের জীবন দর্শন ও জীবন বিধান সম্পূর্ণ নির্ভুল। পৃথিবীর অন্য কোনো জাতির কাছে নির্ভুল জীবন বিধান নেই। সারা বিশ্বে আমাদের সোয়াশো কোটি মুসলমান ভাই আছে। তারা আমাদের অংশ। তারা আমাদের সাহায্যকারী ও সহযোগী। এই বিষয়গুলোকে সামনে রেখে আমাদের দেশে চালু করতে হবে নতুন এক শিক্ষা ব্যবস্থা। প্রণয়ন করতে হবে নতুন শিক্ষানীতি, নতুন কারিকুলাম, পাঠ্যসূচি, পাঠ্যতালিকা। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় উপরোক্ত ভাবধারাগুলো গতিশীল থাকতে হবে নদীর স্রোতধারার মতো। এই নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা হবে এমন শিক্ষা ব্যবস্থা, যে শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের একটি আদর্শ ও সুসংহত জাতিতে পরিণত করবে। আমাদের জাতিকে প্রকৃত মুসলিম উম্মাহ হিসেবে গড়ে তুলবে। আমাদের জীবনকে সামগ্রিক উন্নতির শিখরে আরোহণ করাবে। স্বাধীন মর্যাদাবান জাতি হিসেবে টিকে থাকতে শিখাবে। আমাদেরকে পরকালের মুক্তির পথে পরিচালিত করবে। দক্ষতার সাথে দেশ ও জাতিকে পরিচালনার যোগ্যতা দান করবে। আসলে এ ধরনের আংশিক মেরামত, সংস্কার, সংশোধন ও সংযোজন দ্বারা ফল হবেনা। প্রয়োজন আমূল পরিবর্তনের।
প্রাইভেট টিউশনি বন্ধ করতে হবে
প্রাইভেট টিউশনি নিয়ে সাম্প্রতিককালে নানা মহলে উদ্বেগ বাড়ছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত অভিভাবকদের এ উদ্বেগ বেশি। শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ার খরচ অনেক অভিভাবকই বহন করতে সক্ষম নন; কিন্তু কষ্ট করে অভিভাবকদের এ খরচটুকু জোগাড় করতে হচ্ছে। শিক্ষাবিদ ও শিক্ষার নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও এ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ার প্রবণতা যেভাবে বেড়েছে, তা অতীতে কখনও দেখা যায়নি। অপরদিকে শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে যথাযথভাবে না পড়িয়ে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানোয় আগ্রহী বলেও কথা উঠেছে। ফলে কিছুদিন আগে একবার শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো বন্ধে আইন প্রণয়নের কথা শোনা গিয়েছিল। সম্প্রতি অবশ্য এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য শোনা যাচ্ছে না। তবে তা বন্ধ না করলে শিক্ষা ব্যবস্থার আরো চরম অবনতি হবে, যা দেশের ভবিশ্যৎ প্রজন্মের জন্য অমঙ্গলকর।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শিক্ষার মান উত্তরণ
শিক্ষা একটি জাতির উন্নতির সোপান। দু:খজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশের শিক্ষার সার্বিক মান এখনও আন্তর্জাতিকমানের নয় এবং দিন দিন এ ব্যবধান বেড়েই চলেছে। স্বাধীনতার পর থেকে সরকারগুলির শিক্ষা নিয়ে সু-নির্দিষ্ট কোন প্ল্যান না থাকা এবং সেই সাথে শিক্ষাঙ্গনগুলির বেশ কিছু মৌলিক সমস্যা সমাধানে উদাসীন থাকা এর একটি প্রধান কারন। এছাড়াও শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ না হওয়া এবং তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ হিসাবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটও শিক্ষার কাংখিত মান অর্জনে ব্যর্থতার একটি বড় কারন। তবে আশংকার কথা হচ্ছে আমাদের শিক্ষা মানের ক্রমাবনতি ঘটছে। বাংলাদেশ জন্মের অনেক আগে থেকেই এদেশের মানুষ দেখেছে উচ্চশিক্ষার পীঠস্থান এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কিভাবে অনুপ্রেরণা দিয়ে জাগ্রত করেছে জাতিকে, শিক্ষার আলো দিয়ে কিভাবে সংহতি আর একাত্মতায় প্রতিবাদী করেছে শাসকদের অন্যায় আচরণ রুখতে। সেই সাথে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শিক্ষার মান, আলোচিত হয়েছে শিক্ষকমন্ডলীর গবেষণা নিষ্ঠা আর শিক্ষাদানে একাগ্রতা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি অভিহিত হয়েছে নানা প্রশংসাসূচক অভিধায়। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতি সেই স্বর্ণালী সময়ের কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। এ সকল কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রতি এ দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেক। কিন্তু যুক্তিসংগত কারণেই সাম্প্র্রতিক সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শিক্ষার মান প্রশ্নসূচক অভিধায় পর্যবসিত হচ্ছে বারবার। শিক্ষার মান প্রকৃতপক্ষে একটি আপেক্ষিক ধারণা। যে শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে মানবজাতি ও দেশের সার্বিক কল্যাণে, তার অবদান রাখার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়, তাকে আমরা একটি ভালো মানের শিক্ষা বলতে পারি।
দেশে মুলত: দুই ধরনের বিশ্বিবদ্যালয় আছে- পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়।
অবিভক্ত বাংলার প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে ১৮৫৭ সালে আত্মপ্রকাশ ঘটে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের। সময়ের পথ পরিক্রমায় ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। স্বাধীনতা পূর্বকালীন এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সাথে পরবর্তীকালে যুক্ত হয় আরো কিছু উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। আর ১৯৯২ সালে দেশে উন্মেষ ঘটে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের।
সম্প্রতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-রাজনীতি ও শিক্ষক-রাজনীতি সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা, সেশন-জট, ধর্মঘট, আন্দোলন, কাস, পরীক্ষা বর্জন, মারামারি, ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া প্রভৃতি ঘটনার কারণে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অভিভাবকদের কাছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। এ সকল অভিভাবকগণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকল্প হিসাবে বেছে নিচ্ছেন বে-সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে। এর বাইরে সামগ্রিক মেধায় পিছিয়ে থাকা সমাজের উচু শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রী যাদের অধিকাংশই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়ার চ্যালেঞ্জে উত্তীর্ণ হতে অক্ষম, তাদের জন্য উচ্চ শিক্ষার সুযোগ নিয়ে এসেছে বে-সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছাড়া দেশের অধিকাংশ বে-সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কেই বিশ্ববিদ্যালয় কঠামোর ভিতর ফেলা যায় না। সার্টিফিকেট প্রদানকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষামানও অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অপেক্ষা নিম্ন মানের।
আমি এখানে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মানের সাম্প্রতিক অবস্থা, মানের অবনতির কারন ও মানোন্নয়নে করণীয় সম্পর্কে বেশ কিছু পর্বে লেখার আশা করি। প্রথমেই জানিয়ে দেই এটি মুলত: একটি সেমিনার এ পঠিত মুল প্রবন্ধ যেখানে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির নীতি নির্ধারকগন উপস্থিত ছিলেন। তারা শুনেছেন, বাহবা দিয়েছেন, অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আমার জানামতে এখন পর্যন্ত কোন পরিবর্তন হয়নি। আসলে কোন পরিবর্তনের জন্য সমাজের সচেতনতা প্রয়োজন। শুধু সেমিনার এ পেপার পড়ে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয় এবং সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই এই ব্লগে লেখা।
আর কোথাও থেকে কপি-পেষ্ট করছিনা। এটি আমারই লেখা। এখানে প্রবন্ধটি সংক্ষিপ্ত রুপে উপস্থাপন করলেও অনেক ক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহার একই রকম থেকে যেতে পারে। সেজন্য ক্ষমাপ্রার্থী। দেশের অন্যতম প্রধান এই সমস্যাটি দুর করার ক্ষেত্রে আপনারা আপনাদের মন্তব্য রাখবেন বলে আশা করি।
বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শিক্ষার মান কিছু সুনির্দিষ্ট সূচকের মাধ্যমে পরিমাপ করা হয় এবং তার ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির র্যাংকিংও করা হয়। দুঃখের বিষয় এই সূচকগুলির ভিত্তিতে করা বিশ্বের ৫০০ টি কিংবা এশিয়ার ১০০ টি বিশ্ববিদ্যালয় – এর মধ্যেও বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় এর নাম নেই।
এখন দেখে নেয়া যাক শিক্ষার মান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মান পরিমাপের সেই সূচকগুলি কি কি –
– ভর্তি প্রক্রিয়া
– পাঠ্যক্রম ও বিষয়ের ব্যপ্তি
– ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত
– মেধা যাচাই প্রক্রিয়া
– গবেষণা
– গবেষণা প্রকাশনা ও এর মান
– পাশকৃত গ্র্যাজুয়েটদের গন্তব্য
– আন্তর্জাতিক ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোলাবরেশন
শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের মানোন্নয়ন
শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের মানোন্নয়নে প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তাই কারো কারো মতে, গবেষণা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোগত উন্নয়নে কম বরাদ্দ রাখায় বাজেটে নতুন কোন বৈচিত্র্য আসেনি। দিন বদলের অঙ্গীকার ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তাদের কাছে জাতির প্রত্যাশা ছিল আরো বেশী। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হলে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আরো বাড়ানো উচিত ছিল। বাজেটে শিক্ষার উন্নয়ন খাতে চেয়ে অনুন্নয়ন খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে বেশী। অধিকাংশ অর্থই ব্যয়িত হবে বেতন-ভাতা ও পেনশন প্রদানে। কিন্তু শিক্ষার মানোন্নয়নে গবেষণা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে কম বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ও পরিকল্পনায় পর্যায়ক্রমে স্নাতক পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করা এবং তথ্য ও প্রযুক্তি সেক্টর গুরুত্ব পেয়েছে।
শিক্ষার বানিজ্যিকীকরণ প্রবণতা বন্ধ করা
একটি জাতিকে উন্নয়নের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হলে শিক্ষা খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হয়। তা না হলে দেশের মেধাবী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরকে জাতীয় উন্নয়নে শরিক করা যাবে না। তাই উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকারের প্রয়োজন ছিল শিক্ষা খাতে কমপক্ষে মোট জাতীয় বাজেটের ২৫ শতাংশ এবং জাতীয় আয়ের ৮ শতাংশ বরাদ্দ রাখার। দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে ও জনশক্তিকে মানব সম্পদে রূপান্তরিত করতে শিক্ষার বানিজ্যিকীকরণ প্রবণতা বন্ধ করা এবং মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষা খাতে এ বরাদ্দ জরুরী।
প্রশাসনকে ই-গভার্মেন্টে রূপান্তরিত করা
আমাদের দেশের অন্যান্য সেকটরের মতো শিক্ষা ক্ষেত্রেও দুর্নীতি মহীরুহে পরিণত হয়েছে। গত কয়েক দশক ধরে শিক্ষা বাজেটের একটা বিরাট অংশ দুর্নীতিবাজদের পকেটে চালান হয়ে যাচ্ছে। তাই সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে দুর্নীতি ঠেকানোর জন্য সর্বপ্রথমে শিক্ষা ক্ষেত্রে দুর্নীতি কঠোরভাবে দমন করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে দেশের সব সরকারী কলেজগুলোকে ইন্টারনেট সুবিধার আওতায় আনা হচ্ছে। তাছাড়া সব সরকারী শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ, কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট, আলিয়া মাদ্রাসা, শিক্ষা বোর্ড, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটকেও এ সুবিধার আওতায় আনা হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরাসরি তথ্য আদান-প্রদান করা হবে ই-মেইল ও ওয়েব সাইটের মাধ্যমে। আর ইন্টারনেটের মাসিক বিল প্রদান করতে হবে প্রতিষ্ঠানগুলোর বেসরকারী তহবিল থেকে।
শিক্ষা প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো
শিক্ষক-অভিভাবক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির জন্য গতানুগতিক অনমনীয় প্রশাসন থেকে বেরিয়ে এসে নমনীয় বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনায় ফিরে আসা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের দৈনন্দিন অথবা সাপ্তাহিক কর্মসূচীতে অভিভাবকদের সাথে মত বিনিময়ের জন্য নির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ রাখা যেতে পারে । বর্তমান ব্যবস্থাপনায় অভিভাবকরা প্রয়োজনে প্রধান শিক্ষকের সাথে আলোচনা করতে পারেন, কিন্তু একজন প্রধান শিক্ষক বা সহকারী প্রধান শিক্ষকের পক্ষে সকল অভিভাবকের সাথে আলোচনা করা অনেকটাই অসম্ভব । তাছাড়া প্রশাসনিক বিষয় ছাড়া একাডেমিক বিষয়ে অভিভাবকদের সাথে আলোচনা খুব কমই হয়ে থাকে । বিদ্যালয় কর্মসূচিতে সময় নির্ধারণের ক্ষেত্রে আরও যে বিষয়টি বিবেচ্য তা হলো অভিভাবকদের পেশাগত দিক । কারণ অনেক পরিবারেই অভিভাবক সদস্যই কোন পেশায় জড়িত থাকতে পারেন।
যথাযথ শিক্ষানীতি প্রনয়ণ করা
দেশে এমন একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা যাতে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের তুলনায় কোন অংশে কম না হয়। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষানীতি এখনো সেই সনাতনধর্মী কেরানী তৈরীর শিক্ষা ব্যবস্থা রয়ে গেছে। গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে এসে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে, শিক্ষা ব্যবস্থায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষানীতিটাকে ঢেলে সাজিয়ে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন করা সম্ভব করা যাবে। শত বাধা বিপত্তির মাঝেও দেশের আপামর জনগনের কল্যানে ও দেশের মানুষের ভাগ্য নির্মানের জন্য যথাযথ একটি শিক্ষানীতি থাকা প্রয়োজন।
শিক্ষা প্রশাসনকে দূর্ণীতিমুক্ত করা
বাংলাদেশে পুলিশ প্রশাসনের পর শিক্ষা প্রশাসনের দূর্ণীতি। এখানের দূর্ণীতির কারণে এর শিকার হয় প্রথমেই শিক্ষক সমাজ, অত:পর শিক্ষার্থীরা। একে একে জাতির প্রত্যেকটি মানুষ দূর্ণীতির শিকারের আওতায় পড়ে। বিশেষ করে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এর দূর্ণীতির শিকার। এদের নিজেদের এমপিও ভুক্ত করার জন্য প্রথমে বিদ্যালয়ের প্রধনিশিক্ষক ও সভাপতি। অত:পর উপজেলা শিক্ষা অফিসার, জেলা শিক্ষা অফিসার সর্বশেষ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে মোটা অংকের টাকা খরচ করতে হয়, যদিও এ কাজটির জন্য সেই কর্মকর্তা চাকুরী করে থাকে। শিক্ষা বোর্ডগুলিও দূর্ণীতির আখড়া। সেখানে বিদ্যালয়ের কোন একটি বিষয় অনুমোদন, রেজিষ্ট্রেশন করা, ফর্মফিলাপ করা, কমিটি অনুমোদন ইত্যাদি কাজের জন্য যেতে হয়। কিন্তু কোন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে টাকা না দিয়ে কোন কাজ করা যায় না। শিক্ষার এসকল প্রশাসনকেদূর্ণীতি মুক্ত করা উচিৎ।
শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান করা
কোন জাতির শিক্ষার বাহক হলো শিক্ষক। শিক্ষকদের যদি সঠিকভাবে গঠন করা যায় তাহলে জাতির শিক্ষার বিস্তার হবে পৃথিবীর অন্যান্য জাতির শিক্ষার বিস্তারের চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে। বাংলাদেশের শিক্ষকদের পৃথিবীর অন্যান্য সকল দেশের চেয়ে সর্ব নিম্ন বেতন দেয়া হয় এবং ভাল কোন প্রশিক্ষনের মাধ্যমে তার দক্ষতা উন্নয়নের কোন রকম চিন্তা করা হয়না। সরকারকে দেশের শিক্ষক সমাজের উন্নততর প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করে তাদের দক্ষতা অর্জনে ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষাকে আরো দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ অতি জরুরী।
শিক্ষকের বেতন বৃদ্ধি
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা যে নাজুক অবস্থায় রয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তৃতীয় বিশ্বের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যতগুলো সমস্যা থাকার কথা তার সবগুলোই এখানে আছে। তৃতীয় বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থায় গলদ যত বেশি তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের পকেট ভারী করার সুযোগও তত বেশি। এই প্রজেক্ট, সেই প্রজেক্ট-প্রজেক্টের কোন অভাব নেই। যত্রতত্র এনজিও’রও অভাব নেই। বিদেশি ডোনারদের থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতানোই এদের কাজ। যখন রাষ্ট্র তার অবশ্য পালনীয় কর্তব্যে ব্যর্থ হয় তখন বিদেশি দাতা গোষ্ঠীর মাধ্যমে ধনী রাষ্ট্রগুলো কিছু ফায়দা লোটার চেষ্টা করে। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে শিক্ষা উন্নয়ন নিয়ে বহু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। একটি প্রকল্প শেষ হয়েছে তার দ্বিতীয় ফেজ শুরু হয়েছে। দেশি বুদ্ধিজীবিরা বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়েছে মোটা অংকের টাকা আর সাদা চামড়া ও চকচকে কালো চামড়ার বিদেশি বিশেষজ্ঞরা নিয়েছে মোটা অংকের ডলার। কিছু গ্রামীণ বিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে, পাঠ্যক্রমে বিদেশি পাঠ্যপুস্তকের জটিল অনুবাদ কপি-পেস্ট করা হয়েছে। এতে পাঠ্যক্রমের ধারাবাহিকতায় অসামঞ্জস্যতা প্রকট হয়েছে। আর যেটা হয়েছে সেটা হল বছরে বছরে শিক্ষাক্রমের পরিবর্তন। প্রচুর শিক্ষার্থী হয়েছে গিনিপিগ। শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক গুণগত পরিবর্তন খুব সামান্যই হয়েছে। এর পেছনের কারণ খতিয়ে দেখলে দেখা যায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন শেষে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি গ্রহণ, বিদেশ গমন, শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ না করা আমলা কর্তৃক শিক্ষাক্রম প্রস্তুতকরণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণকে গণহারে শিক্ষাবিদ উপাধি দিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বিশেষজ্ঞ হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে কাজ করানো। শিক্ষাবিজ্ঞান এখন এত বড় একটি ক্ষেত্র যে এটি নিয়ে দীর্ঘ সময়ে কাজ না করলে এবং তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক পর্যায়ে যথাক্রমে পড়াশোনা ও কাজ না করলে কোন স্থায়ী, গ্রহণযোগ্য ও মানসম্মত শিক্ষা পদ্ধতি উপহার দেওয়া সম্ভব নয়। তার চেয়েও বড় ব্যাপার হল, প্রচলিত শিক্ষাক্রমেই অনেক উন্নতমানের শিক্ষা নিশ্চিত করা যেত যদি মেধাবী ও উন্নত মানসিকতার তরুণরা গণহারে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিত। আইন যেমনই হোক না কেন যোগ্য ও সৎ বিচারপতি ঠিকই ন্যায়বিচার উপহার দিতে পারেন। ঠিক তেমনি শুধুমাত্র সমাজের উচ্চ মেধাস্তরের ছেলেমেয়েদের স্কুল পর্যায়ের শিক্ষকতা পেশায় সম্পৃক্ত করা গেলেই বর্তমান শিক্ষা সমস্যার সিংহভাগ সমাধান হয়ে যেত।
শিক্ষার্থীর স্বাধীনতা
মানুষের পরিপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে স্বশাসন বা স্বনিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত । শিক্ষাক্ষেত্রেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মানুষ জন্মগ্রহণ করে স্বাধীনতা ভোগ করার নিমিত্তে। শিশুকে খাওয়ানোর সময় সে হাত দিয়ে চামচ ধরতে চায় এবং নিজে খেতে চায়, হাঁটার জন্য নিজে পা বাড়ায়, বড় হলে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য কাজ খোঁজে। এগুলো সবই স্বাধীনতা লাভের জন্য প্রচেষ্টাসমূহ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এই জন্মগত স্বাধীনতার প্রবৃত্তি শিশু স্কুলে অনুসরণ করতে পারে না। শিশু শিক্ষার্থীরা সব সময়ই খুব বেশি উত্তেজিত থাকে এবং বিমোহিত হয় নতুন কিছু জানার জন্য এবং নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। কিন্তু তাদের নিয়মানুবর্তী করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তাদের সৃষ্টিশীল প্রতিভা বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে দাড়ায় স্কুলের শাসন এবং শিক্ষার্থী বঞ্চিত হয় তার স্বাধীনতা থেকে। এই স্বাধীনতা হরণ চলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত। অথচ এই সময় একজন শিক্ষার্থীর শারীরিক ও মানসিকভাবে বেড়ে ওঠার প্রকৃত সময়।
প্রতিটি মুহূর্তেই আমরা জ্ঞান অর্জন করি বা করার বৃত্তের মধ্যে অবস্থান করি। ’ক্রিটিক্যাল পেডাগজি’ বলছে যে, শিক্ষক শিক্ষার্থীর কাছেও শেখে,শুধু শিক্ষার্থী শিক্ষকের কাছ থেকে শিখে না। ধরুন, উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তার ছেলে বা মেয়ে তার পরিবার এবং তার চারপাশ থেকে অনেক বিষয় শিখে যেগুলো একজন শিক্ষকের জানা নাও থাকতে পারে। আমার এক সহকর্মী বলেছিলেন, (উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার মেয়েরা যখন কলেজে পড়ছে) ওদের কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। দেখলাম ব্যাপারটি আসলেই সত্য। অতএব, পেডাগজি শুধু শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক হবে না, হবে শিক্ষাকেন্দ্রিক। শিখন পরিবেশ সৃষ্টিশীল হয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মত ও ভাব আদান-প্রদানের মাধ্যমে। এভাবে বলা যায়, কেহই পূর্ণ শিক্ষিত নয়। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ব্যক্তিগত চাহিদা অনুযায়ী পূর্ব অভিজ্ঞতা ও বিশ্বাস অনুযায়ী শিখতে পারে এবং জীবনের বাস্তবতার জন্য নতুন পথের সন্ধান পেতে পারে।
সরকারকে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে
একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে শিক্ষার অবদান অপরিসীম। একটি দেশের শিক্ষাখাতে সরকারের ব্যয় মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) শতকরা কত ভাগ তার উপর সেদেশের কর্মপরিকল্পনায় শিক্ষাকে কতটুকু অগ্রাধিকার প্রদান করা হচ্ছে সেটার নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। শিক্ষা খাতে সরকারী ব্যয়- যেমন বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান যেগুলো শিক্ষা সেবার সাথে সম্পৃক্ত সেগুলোর জন্য সরকারের ব্যয়িত অর্থের দ্বারা নির্ধারিত হয়। এ ব্যয় শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয়ের সাথে সম্পৃক্ত নয়, শিক্ষার্থীদের ও তাদের পরিবারগুলোর অন্যান্য পরিসেবা যেগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়ে থাকে, তার সাথেও জড়িত।
জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য শিক্ষা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ অপরিহার্য। প্রকৃতপক্ষে জাতীয় উন্নয়নে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের সুফল আসে ধীরে ধীরে। আর তাই সেটা অনেক সময় তাৎক্ষনিকভাবে আমাদের চোখে পড়ে না। এ কারণেই হয়তো আমাদের দেশে শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ক্রমাগত কমছে। অথচ অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। অর্থনীতিবিদ আর্থার শুলজ্ দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করা সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ এবং উচ্চ শিক্ষায় ১১ শতাংশ। শিক্ষার অর্থনীতি (Economics of Education) নিয়ে গবেষণা করে মৌলিক অবদান রাখার জন্য রবার্ট সলো এবং আর্থার শুলজ্ অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পর্যন্ত লাভ করেন।
একটি দেশের মানব সম্পদ উন্নয়নের মধ্যে দিয়ে জাতীয় উন্নয়নের জন্য জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হয়। তাই রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শিক্ষা ফোরাম ২০০৬ বিশ্বের সব দেশগুলোকে তাদের জিডিপি-র কমপক্ষে ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয়ের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, শুধু প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ নয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় বিনিয়োগ উদীয়মান অর্থনীতির জন্য অধিক ফলপ্রদ। কারণ দক্ষ ও জ্ঞান-ভিত্তিক জনবল তৈরীর জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা প্রধান নিয়ামক। ফোরামের মতে, জ্ঞান ও সংস্কৃতি নতুন প্রজন্মের কাছে স্থানান্তরের মাধ্যম হিসেবে শিক্ষা ব্যবহৃত হওয়া উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমরা সেই লক্ষ্য অর্জন করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছি।
উত্তরণের উপায়ে কিছু সুপারিশ
শিক্ষা ব্যবস্থায় সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন-
১. শিক্ষকতা পেশায় মেধা সম্পন্নদের সুযোগ করে দেয়ার জন্য নিয়োগ পদ্ধতি পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে।
২. প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক পাসের বাধ্যবাধকতা তুলে দিতে হবে। কেননা এম.পি.ও. চালু রাখার জন্য শিক্ষকরাই নকলে সহায়তা করেন।
৩. শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার্থীরা যেন বেয়াদবী না করে, আনুগত্য বজায় রেখে চলা-ফেরা করে সে জন্য টিউটোরিয়াল, টার্মিনাল ও মৌখিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নিতে হবে।
৫. প্রশ্ন প্রণয়নের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দেয়া যাবেনা। বিশেষ করে সমিতির প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়া বন্ধ করতে হবে।
৬. এমন আইন প্রণয়ন করতে হবে, যেন কোন অবস্থাতেই শিক্ষকরা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীকে প্রাইভেট পড়াতে কিংবা কোচিং করাতে না পারে।
৭. শিক্ষকদের কাজে উৎসাহী ও মনোযোগী করে তোলার লক্ষ্যে ন্যায়নিষ্ঠ-নীতিবান শিক্ষকদের মূল্যায়ন করে পুরস্কৃত করতে হবে এবং গোপন রিপোর্টের ভিত্তিতে যোগ্য, সৎ ও দক্ষ শিক্ষকদের কাজের মূল্যায়ন করতে হবে। প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রমোশন দিতে হবে।
৮. অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে বদলির ব্যবস্থা করতে হবে।
৯. শিক্ষা ভবনের ঘুষ বাণিজ্য দূর করতে হবে, যেন শিক্ষকরা তাদের টাইমস্কেলের কাজসহ অন্যান্য কাজ নির্বিঘ্নে এবং বিনা পয়সায় করতে পারেন।
১০. কলেজ এবং মাদ্রাসার শিক্ষকদের (প্রভাষক) বেতনের অনুপাতের প্রচলিত ঘৃণ্য নিয়ম বাতিল করতে হবে।
১১. মানবিক মূল্যবোধ তৈরী করে এমন শিক্ষা (নৈতিকতা সম্বলিত) সিলেবাসে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।
১২.প্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার (১ম সাময়িক, ২য় সাময়িক ও বার্ষিক) খাতা মূল্যায়নের পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হবে। প্রয়োজনে এক প্রতিষ্ঠানের খাতা অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষককে দিয়ে মূল্যায়ন করাতে হবে।
১৩. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুকুল পরিবেশ গড়ে তুলতে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত রাখতে হবে। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এ ব্যাপারে সকল রাজনৈতিক দলের একমতে পৌঁছানো উচিত।
১৪. সেশন জট দূর করে সময়ের পরীক্ষা সময়ে নিতে হবে।
১৫. শিক্ষার্থীর আর্থিক সমস্যা দূর করার লক্ষ্যে বৃত্তির সংখ্যা এবং টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে।
১৬. রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং প্রসাশনের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের সন্তানের স্কলারশীপ ও উচ্চতর ডিগ্রী ব্যতীত পড়া-লেখার জন্য বিদেশে পাঠানো নিষিদ্ধ করতে হবে।
১৭. লেজুর ভিত্তিক রাজনীতিতে জড়ানো থেকে ছাত্রদের রক্ষা করতে হবে।
১৮. কঠোর আইন করে শিক্ষক রাজনীতি ্বন্ধ করতে হবে।
১৯.শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রসাশনিক ও আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে।
২০. প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে রাজনৈতিক ব্যক্তির পরিবর্তে সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে।
উপসংহার
সাধারণত আচরণের ধনাত্বক পরিবর্তনকে শিক্ষা বলা হয়। একজন মানুষকে ভালভাবে বাঁচতে হলে প্রথমে যে কয়টি মৌলিক বিষয় দরকার তার একটি হল শিক্ষা। শিক্ষা মানুষের অন্তর্নিহিত গুনাবলীর প্রকাশ ঘটিয়ে থাকে।
শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করতে পারেনা। অতি প্রাচীন কাল থেকেই আমাদের দেশে শিক্ষার প্রচলন ছিল। সেই সময়ের শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষার কাঠামো সবই ছিল বেশ সহজ ও সরল। কিস্তু দিন বদলের সাথে সাথে তা হয়ে উঠেছে জটিল থেকে জটিলতর। এর সাথে যুক্ত হয়েছে নানান মুখি শিক্ষা ব্যবস্থা। দিন যত যাচ্ছে ততই আবিষ্কার হচ্ছে ভিন্ন ধরনের শিক্ষা কাঠামো, শিক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষণ পদ্ধতি, প্রশাসন ব্যবস্থা ইত্যাদি। আর এর সব কিছু মিলে গঠিত হয় একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা।
আমাদের শিক্ষার্থীরা বর্তমানে কিছু জানার চেয়ে ভালো রেজাল্টের দিকেই বেশি আগ্রহী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে উন্নত প্রযুক্তি-ইণ্টারনেট থাকলেও এগুলোর যথাযথ ব্যবহার না করে শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুক ব্যবহার করছে। কিন্তু এই তথাকথিত ভালো রেজাল্ট তাদের কি কোন সাহায্য করছে? এইসব মেধাবীরা অনেকেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না। পরবর্তীতে তথাকথিত ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা স্মার্ট মানুষ তৈরির কারখানা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে স্মার্টনেসের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। এগুলোর বেশিরভাগই নামসর্বস্ব। একটি উদাহরণ দিচ্ছি-বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয়(World University)। বিশ্ব নামের একটি বিশ্ববিদ্যালয় অথচ সেখানে বিশ্বের অন্য কোন দেশের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী আছে কিনা সন্দেহ! অর্থাৎ নামের সাথে কাজের কোন মিলই নেই। যার নামেরই ঠিক নেই, তার কাছ থেকে নিশ্চয়ই ভাল কাজ আশা করা বলাই বাহুল্য। বর্তমান সরকার শিক্ষার উন্নয়নের জন্য সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালু করেছে। কিন্তু শিক্ষক ও শিক্ষার্থী কেউ এটি ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারেনি।শিক্ষকগণ এখনো বুঝেই উঠতে পারেননি প্রশ্নপদ্ধতি কি রকম হওয়া উচিত। যে দেশের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান বলেন, এটি কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সে দেশের শিক্ষা কীভাবে উন্নত হবে? এটি কথার কথা নয়, একটি বাস্তব উদাহরণ। শিক্ষকদের বেশিরভাগেরই শিক্ষক নিবন্ধন সার্টিফিকেট নেই। অনেকের শিক্ষকতার জন্য প্রয়োজনীয় ডিগ্রি বি.এড-ও নেই।
এতকিছু সত্ত্বেও আশা করছি, শিক্ষকরা তাদের দায়িত্ব বুঝে শিক্ষকসুলভ মানসিকতা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞান বিতরণ করবেন। আমরা আমাদের স্বপ্নের দেশ পাবো।
(বিভিন্ন বই, জার্নাল, ব্লগ ও ওয়বে সাইট এর সাহায্যে)