আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে বিভিন্ন প্রকার মূল্যবোধের অবস্থান বিশ্লেষণ - SMH Amiri

সর্বশেষ লিখাসমূহ

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে বিভিন্ন প্রকার মূল্যবোধের অবস্থান বিশ্লেষণ


মূল্যবোধ ছাড়া কোন কিছু মূল্যবান হয় না। সামাজিক মূল্যবোধ সংস্কৃতির অন্তর্গত বিষয়। তাই সামাজিক মূল্যবোধের সর্বঙ্গ সাংস্কৃতিক মূল্যবোধও অনেক ক্ষেত্রে পাল্টে যায়। মূল্যবোধের পাত্রে যে রঙ ধারণ করে, সংস্কৃতিক সে রঙ ধারণ করতে বাধ্য। মূল্যবোধের ধরাবাঁধা কোনো পথ নেই। সংস্কৃতির আইল বেয়েই তাকে পথ চলতে হয়। বস্তুত মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি অঙ্গাঙ্গি জড়িত। মূল্যবোধ যেহেতু সংস্কৃতিরই এক ভগ্নাংশ, সেহেতু সংস্কৃতিহীন মূল্যবোধের কথা চিন্তা করা যায় না। আমরা বলি, আজকে অনেক ক্ষেত্রেই মূল্যবোধ কমে গেছে কিংবা আগের মতো সে মূল্যবোধ নেই। এক্ষেত্রে আমরা অপসংস্কৃতিকেই দায়ী করি। কারণ দেশে কিংবা সমাজে অপসংস্কৃতি আমদানির ফলে আমাদের মূল্যবোধে হোঁচট খায় কিংবা চিড় ধরে। এটি সমাজ দেশ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি ধর্মীয় মূল্যবোধের ক্ষেত্রেও।

মূল্যবোধ নানা কারণেই বিপর্যস্ত হয় যেমন অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি, সামাজিক অস্থিরতা, অপসংস্কৃতি, আবহাওয়া, ঋতু পরিবর্তন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সঙ্গীত, সাহিত্য, ভাষা ইত্যাদি। সমাজে রাষ্ট্রেই অর্থনীতি ও রাজনীতিতে মূল্যবোধ প্রভাব ফেলে। যে কোনো ক্ষেত্রে অবক্ষয় দেখা দিলেই মূল্যবোধের অবচয় (উবঢ়ৎরষরধঃব) হয়। মূল্যবোধে ধস নামে। আমরা এ ধরনের পরিবেশে সুন্দর এবং সুষ্ঠু মূল্যবোধ নিয়ে বাস করতে পারি না। বাস করাও সম্ভব নয়।


মূল্যবোধ

‘মানব’ প্রকৃতির সাথে ‘ইক’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে গর্বিত হয় ‘মানবিক’ শব্দটি। আবার মানব শব্দটিকে প্রকৃতি ও প্রত্যয়ে ভাঙলে পাই মনু+অ (ষ্ণ)। অর্থাৎ মানবিক শব্দটির মূল বিশেস্নষণ করলে তার ভাবার্থ আমরা বুঝতে পারি। আর মানবিক শব্দটির পাশে যখন মূল্যবোধ শব্দটি বসে তখন তা নতুন অর্থ সৃজন করে। ঐ শব্দদ্বয়ের মধ্যে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদীতা, সহনশীলতা, দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবোধ ইত্যাদি সুকুমার গুণাবলির সমন্বয় রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের সমাজ থেকে, দেশ থেকে এই মানবিক মূল্যবোধ যেন বিলুপ্ত হতে বসেছে। অনেক দিন আগে স্বভাব কবি গোবিন্দ দাস বলেছেন, ‘বাঙালি মানুষ যদি প্রেত কারে কয়।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘সাতকোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী/রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ কর নি।’ অর্থাৎ যে জিনিসের অভাবে কবি ক্ষোভ জড়ানো কণ্ঠে বাঙালিকে মানুষ বলতে পারেননি তা হচ্ছে মানবিক মূল্যবোধ। বিবেক বর্জিত, মূল্যবোধহীন মানুষ সবদেশে, সব জাতির মধ্যেই কম বেশি আছে। বাঙালি জাতির মধ্যে সে সংখ্যাটা একটু বেশি। নইলে দেশের বা জাতির আজ এই মুমূর্ষু দশা হতো না। মানবিক মূল্যবোধের চর্চাই পারে মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হতে সাহায্য করতে। বাহ্যিক সৌন্দর্যের পরিচর্যার পাশাপাশি অন্তরের সৌন্দর্যেরও পরিচর্যা করা উচিত। জাগ্রত মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ কখনও অন্যায় করতে পারে না, কখনও তার দ্বারা অপরের ক্ষতি হতে পারে না। বিবেককে সঙ্গী করে যে সুবোধ তৈরি হয়, তা দ্বারা মানুষ ভুল পথে পরিচালিত হতে পারে না। তাই প্রত্যেকের উচিত মানবিক মূল্যবোধের চর্চা করা। তবেই বদলে যাবে জাতি, বদলে যাবে দেশ।


অর্থনৈতিক মূল্যবোধ

সাধারণ অর্থে, আমরা সেই জিনিসের আর্থিক মূল্য আছে বলে বিবেচনা করি, যার বিনিময়ে অর্থ পাওয়া যায়। সম্পূর্ণ বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে, তা গূঢ় তাৎপর্য উপলব্ধি করা যায়। এখানে লক্ষণীয়, আমরা অর্থকে বা বস্তুকে তার নিজস্বগুণের জন্য আর্থিক মূল্যসম্পন্ন বিবেচনা করি না। যেহেতু কোন অর্থ বা বস্তু সামগ্রী আমাদের আনন্দ প্রদানে সক্ষম, তাই তাদের আমরা আর্থিক মূল্যসম্পন্ন হিসেবে বিবেচনা করি, অর্থাৎ অর্থের বা বস্তু সামগ্রীর জীবনের সংঙ্গে বা জীবন উপভোগের সাথে সংযুক্ত বলেই তার আর্থিক মূল্য বর্তমান। তাই বস্তুজগতের সঙ্গে আনন্দানুভূতির সংযোজনের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষনের প্রয়োজন। পরিকল্পিত শিক্ষা উপভোগ্য বস্তুসামগ্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত আনন্দানুভূতির সংযোজন ঘটিয়ে ব্যক্তিজীবনে অর্থনৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে পারে।


আমাদের প্রত্যহিক জীবনে সামাজিক মূল্যবোধের অবস্থান

পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক বিকাশের সর্বশেষ স্তর সাম্রাজ্যবাদ দেশে দেশে বিস্তার করেছে। এখন দেশে – দেশে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, তার সার্বভৌমত্যের, সামাজিক মূল্যবোধ নিয়ন্ত্রণের জন্যে আর যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার দরকার নেই। ঠান্ডা যুদ্ধের পর, সোভিয়েত দেশে এবং পূর্ব ইউরোপের দেশ গুলোতে সমাজতান্ত্রিক ব্যাবস্থার পতনের ফলে, মার্কিন রাষ্ট্র এক মেরূর বিশ্বায়নের কাজ খুব দ্রুত গতিতে শুরু করে দিয়েছে। দেশে দেশে চলছে বাজার দখলের কাজ। আর এই পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের বিশ্বস্ত সহায়ক সর্বগ্রাসী বহুজাতিক ভোগবাদী দর্শনের ধারক ও বাহক প্রচন্ড শক্তিশালী সংবাদমাধ্যম বা প্রচারমাধ্যম। দেশের সাধারণ মানুষ, বুর্জুয়া সংবাদমাধ্যমের “ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট” বা opinion” এর কৃপায় বিভ্রান্ত ও চেতনা বিকাশে দিকভ্রষ্ট হয়ে, গঠনমুলক পরিবর্তন এর সাথে ধ্বংসাত্বক পরিবর্তনের রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছে । বিশ্বায়ণের আক্রমণ কেবলমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে না। সাংস্কৃতিক জগতকেও সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন দারূনভাবে প্রভাবিত করছে। সাথে প্রভাবিত করছে আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবি মহল কে। তৈরি করছে আমাদের দেশে তাদের পচ্ছন্দসই “সুশীল গোষ্টি “ এবং তাদের মুখ ঢেকে দিচ্ছে মেকি এবং অতি বামপন্থার মুখোশ দিয়ে। মার্কিন দেশ উন্নত উৎপাদনশীল দেশ , যে সব কিছুর উৎপাদনেই বিশ্বের বাজার দখলের শীর্ষে। তার মধ্যে ওনারা “ওপিনিয়ান “ বা জনমত, অর্থাৎ দেশের মানুষের নিজ্বস্ব বোধবুদ্ধি, চিন্তা – চেতনা বিকাশের সব দায়িত্ব হাতে তুলে নিয়েছেন। প্রত্যেকটি দেশে জনমত তৈরি করার মহান দ্বায়িত্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বৃন্দ কুক্ষিগত করার চেষ্টায় আছে।


বিশ্বায়নের মানবিক মুখ

বিশ্বায়নের মানবিক মুখ বা “Globalization with a Human Face” বা “Millennium Goal “ এর দর্শন প্রচার করতে ব্যাঙ্গের ছাতার মতন জন্ম নিচ্ছে এক গুচ্ছ এন জি ও। এদের কাজই হচ্ছে, তৃতীয় বিশ্বের সাধারণ নীপিড়িত, বিশ্বায়নের দ্বারা শোষিত শ্রেনীর ক্রোধ প্রশমণ করা এবং শ্রেণী সংগ্রাম ও বিক্ষোভ হতে এদের বিমুখ ও ভ্রান্ত করা। এরা দ্বায়িত্ব সহকারে প্রচার করছে যে মানুষের দুঃখ্য, কষ্ট প্রশমন করতে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের প্রবক্তারা কতোটা উদগ্রীব এবং তাই অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক সংগ্রামে গিয়ে কোনো লাভ নেই । মানুষের কষ্ট , দুঃখ্য লাঘব করতে পারে একমাত্র এই এন জি ও গুলি। বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থা (উজ্জ্বল উদাহারণ হিসেবে বিল গেটস ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট) তাদের শোষিত লাভ্যংশের একটি ছোট অংশ এই এন জি ও মারফত কিছু -মিছু খরচা করে প্রমাণ করতে চাইছে যে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের ত্বত্ত্ব কতটা মহার্ঘ এবং তাদের সৃষ্ট প্রচার মাধ্যম কতটা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ্য। শ্রেনী বিভক্ত সমাজে কেউ শ্রেনী নিরপেক্ষ্য নয়। এই নিরপেক্ষ্যতার মুখোশের আড়ালে এই “স্বাধীন” প্রচারমাধ্যম সাথে এন জি ও গুলি অন্তরিক্ষে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করছে এবং প্রভুত সম্পত্তি লুন্ঠন করছে । শ্রমজীবি সর্বসাধারণকে তাদের শ্রেনী সংগ্রাম থেকে বিমূখ করার প্রচেষ্টা। এই “স্বাধীন” ও “নিরপেক্ষ্য” প্রচারমাধ্যমের আরেকটি কাজ হলো নানান দেশের আভ্যন্তরীন রাষ্ট্র ব্যাবস্থায় নাক গলানো। সম্প্রতি চিনের সিংজিয়াং প্রদেশে হান এবং উইঘুর সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দাতা হিসেবে এই প্রচারমাধ্যমের ভূমিকা মারাত্মক রকমের গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ওনাদের দেশের একটি তথাকথিত “গনতান্ত্রীক” সংস্থা (NED National Endowment for Democracy) মাধ্যমে দেশে দেশে “গনতন্ত্র” প্রতিষ্টায় পরিত্রাতা হয়ে অবতরণ করেছেন। এই নেড আমেরিকান উইঘুর কংগ্রেসের সভাপতি রেবিয়া কাদির কে যথেষ্ট উস্কানী এবং মদত দিয়ে সিংজিয়াং প্রদেশ কে চিন থেকে আলাদা করার চেষ্টা করছে। অন্তরিক্ষে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ যথেষ্ট তৎপর। উদ্দেশ্য একটাই সিংজিয়াং প্রদেশকে আলাদা রাস্ট্র করে , চিন কে অর্থনৈতিক ভাবে দূর্বল করা। এবং কাজাখাস্তান, তুর্ক্মেনিস্থান ক্রিমিয়া ইত্যাদি রাষ্ট্র থেকে তেলের দখল কায়েম করা। এই হচ্ছে প্রচারমাধ্যমের নিরপেক্ষ্যতার উদাহারণ। ঠিক এরকমই এন জি ও ও প্রচার মাধ্যমের “হেট ক্যাম্পেনের” মাধ্যমে মার্চ ২০০৮ সালে লাসা তে “ক্রিমসন” বিপ্লব, বার্মা- মায়ান্মারে “গেরুয়া বিপ্লব” , যুগোস্লাভিয়ায় ‘বুলডোজার- বিপ্লব’ , জর্জিয়ায় ‘গোলাপ- বিপ্লব’ , ২০০৪-০৫ সালে ইউক্রেনে কমলা বিপ্লব, ২০০৫ সালে কির্গিস্তানে ‘টিউলিপ – বিপ্লব’ ইত্যাদি নামে ষড়যন্ত্র হয়েছে।

 

পুজিবাদী বিশ্বায়ন

পুজিবাদী বিশ্বায়ন বা সাম্রাজ্যবাদী শাসক গোষ্ঠির মূল দর্শন হলো মুনাফা, আরো লাভ। সেই লাভ করার বিজয় রথ তাদের চালিয়ে নিয়ে যেতেই হবে। সে করেই হোক। যেকোনো দেশের শ্রমজীবি, মজুর শ্রেনী এই পূজিবাদী ব্যাবস্থাতে সবথেকে অর্থনৈতিক স্তরে নিষ্পেসিত , মারাত্মক রকম শোষিত। কিন্ত সেই লাভের ফানুস ফোলাবার জন্যে দরকার এই নীচু শ্রেনীর মানুষের ওপর আরো নীপিড়ন। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন এর এই মূল দর্শন কে প্রচার করার জন্যে দরকার তাই নানান সংবাদমাধ্যম, প্রচার, প্রীন্ট মিডিয়া, দূরদর্শন, ইন্টারনেট, ব্লগ ইত্যাদি। উৎপাদন উপায়ের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটানো হয়, সাথে ঘটানো হয় তথ্য -প্রযুক্তিতে মারাত্মক বা একভাবে বলতে গেলে “ধ্বংসাত্বক” অগ্রগতি। ধ্বংসাত্বক কেন? কারণ এই তথ্য প্রযুক্তির অগ্রগতি ঘটানো হয়, পূজিবাদী অর্থনীতির অভ্যন্তরে অবস্থীত সঙ্কট থেকে মুক্তি পাবার জন্যে। এই অগ্রগতি সৃজনশীল কখনই নয়। কারন তা ব্যাবহারিত হয় আরো তীব্র শোষন এর তাগিদে। আরো মুনাফার তাগিদে। এই মুনাফার করার রথ স্তব্ধ হয়ে গেলে, পূজিবাদী ব্যবস্থার সাথে তার মালিকবৃন্দের পতন ও ধ্বংস অবধারিত। এই তথ্য প্রযুক্তির অগ্রগতি ঘটাতে গিয়ে এবং ঘটাবার পর, চলে প্রকৃতি যার এক অংশ মানুষ, তার ওপর চলে নির্মম শোষন। প্রকৃতির সম্পদ গুলিকে নির্দয় ভাবে নিংড়ে নিয়ে তাকে পরিবর্তন করা হয় ডলারে। প্রাকৃতিক নিয়ম বা ব্যাবস্থা নানান দিক দিয়ে সঙ্কটে পড়ে এই ভারসাম্যহীন শোষণে । প্রাকৃতিক নিয়ম গুলি বিগড়ে যায়। চলতে থাকে মারাত্মক রকম প্রাকৃতিক বিপর্যয়। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের মুল দর্শন মুনাফা এবং আরও মুনাফা কে তাই সুনিশ্চিত করার জন্যে অবলম্বন করা হয় উন্নত তথ্য-প্রযুক্তির সাহায্য উন্নত ও শক্তিশালী প্রচারমাধ্যমের ভূমিকা যে কোনো দেশের সীমানা মানে না, লগ্নি পূজির অবাধ চলাচলের সাথে এই প্রচারমাধ্যমের অত্যন্ত দ্রুততার সাথে অবাধ চলাচলের তাই দরকার হয়ে পড়ে, তা সে ছাপানো নিউজ প্রিন্ট হোক বা ইন্টারনেট , ব্লগ বা টিভি চ্যানেল গুলি। এই মাধ্যম গুলির ঘাড়ে দেওয়া থাকে সবরকমই গুরুদ্বায়িত্ব। তা সে যেকোনো রাজনৈতিক বিষয়ে ওপিনিয়ান তৈরি করে মানুষের সামনে পরিবেশন করা অথবা নানান বস্তুসামগ্রী বিপননের তাগিদে বিজ্ঞ্যাপন(কুরুচিকর হলে আরো ভালো– চিন্তা নেই তার জন্যে মুখ খুলে বসে আছে সহায়ক বহুজাতিক এয়াড এজেন্সী) মাধ্যমে মানুষের মধ্যে মোহ সৃষ্ঠি করা অথবা চরম কুরুচিকর , হিংস্র বা ইতিহাস বিকৃত করে সাম্রাজ্যবাদী (মার্কিন দেবদূত বা এয়াকসান হিরো ইত্যাদি) আমেরিকার প্রয়াসে “শয়তান “ কমিউনিষ্ট নিধনের গল্পাকারে চিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে মানুষের মনের সুন্দর প্রাকৃতিক গঠন কে স-মূলে ধ্বংস করা।, মানুষকে বিভ্রান্ত করা।

 

সুখী-সুন্দর বাংলাদেশ

স্বাধীন বাংলাদেশের গর্বিত মানুষেরা এক রক্তস্রোত অতিক্রম করে ও স্বজন হারানোর বেদনাকে পশ্চাতে ফেলে অগ্রসর হতে চেয়েছে৷ লক্ষ্য ছিল সুখী-সুন্দর বাংলাদেশ৷ যেখানে সৎ ও যোগ্য মানুষরা পাবে প্রাপ্য স্থান৷ দারিদ্র্যমুক্ত ও মানবিক সমাজ নির্মিত হবে৷ মানুষ ভেদাভেদ ভুলে সুশাসনে প্রীত হবে৷ অথচ প্রত্যাশার প্রাপ্তি ঘটেনি৷ সমাজ দেহের রন্ধ্রেরন্ধ্রে বিস্তৃত হয়েছে দুর্নীতি৷ জাতি প্রত্যাশিত গনত্মব্য থেকে এখন অনেক দূরে৷ মানবিকতাশুন্য নেতিবাচক মূল্যবোধ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে সম্ভবনাময় তারুণ্য৷ নেশায় আসক্তি, লাভ ও লোভের সীমাহীন স্বার্থান্ধ হিসাব, সংস্কৃতির নামে নৈতিক স্খলনের আহ্বান, দেশপ্রেমহীন জীবনাচরণ এবং দেশমাতৃকাকে অবহেলা ও উপেক্ষা করে সমৃদ্ধির প্রত্যাশায় দেশত্যাগের প্রবণতাই প্রবল হয়েছে৷ মানুষের প্রতি মানুষের যে দায়িত্ব বা কর্তব্য তা পালন না করাই যেন হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক৷ কিন্তু কেন আমরা এমন ভাঙ্গনের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালাম? উত্তর, আমরা নৈতিকভাবে কাম্য সুদৃঢ় অবস্থানে নেই৷ আমরা কল্যাণ ও সুন্দরের সাধনায় নিবেদিত হইনি৷ আমরা শ্রেয়র ভাবনায় যথার্থ মনোযোগী হইনি৷ এ অবস্থা থেকে উত্তরণ প্রয়োজন৷


মানবিক নতুন প্রজন্ম

সর্বস্তরে দুর্নীতির করতলগত হয়ে দেশের সম্পদ নিঃশেষ হচ্ছে৷ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত দেশপ্রেমহীন কিছু ব্যক্তির প্রভাবে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পথ ধরে এখন তার সামাজিকীকরণ হয়েছে৷ হতাশাগ্রসত্ম তারুণ্য ধাবিত হচ্ছে বিভ্রান্তির পথে৷ সামাজিক ও সামষ্টিক ভাবনার পরিবর্তে ব্যক্তির মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি হচ্ছে৷ এ অবস্থায় প্রয়োজন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, সৎ, দেশপ্রেমিক, নৈতিকতাসম্পন্ন মানবিক মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা, যা জাতির জীবনে অধোগতিকে রোধ করতে পারে৷ এজন্য একটি সার্বিক ও দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন৷ এ আন্দোলন দেশকে উপহার দেবে একটি সৎ, দেশপ্রেমিক, নৈতিকতাবোধসম্পন্ন, মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন, বিজ্ঞানমনস্ক, অসাম্প্রদায়িক, নৈতিক ও মানবিক নতুন প্রজন্ম৷ পূর্বোক্ত সত্য স্বীকার করে নিয়ে বলতে চাই আমরা হতাশ নই৷ আমরা সুস্থ ও সুন্দরভাবে বাঁচতে চাই৷ মূল্যবোধের অভাবহেতু মুমূর্ষ মানবিকতা রক্ষা করার জন্য আমরা সংগ্রাম করতে চাই৷ আমরা নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, মানবিকতা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে চাই৷ আমরা একটি প্রজন্ম নির্মাণ করতে চাই, যারা শ্রেয়মূল্যবোধসম্পন্ন হবে এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে৷ আমরা একটি মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন, সচেতন, সৎ, দেশপ্রেমিক ও মানবিক দৃষ্টিসম্পন্ন নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলতে চাই৷

 

জীবনমান উন্নয়নের জন্যে সচেষ্ট

পৃথিবীতে পদার্পণের পর থেকেই মানুষ বেঁচে থাকার জন্যে ও জীবনমান উন্নয়নের জন্যে সচেষ্ট হয়েছে ৷ এ পৃথিবীকে বশীভূত করার ও প্রকৃতিকে জয় করে একে মানুষের কল্যাণে আরোভালোভাবে ব্যবহার করার লক্ষ্যেই কৃষি ও শিল্প-বিপ্লবগুলো সংঘটিত হয়েছিল ৷ বর্তমানেউন্নয়নে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এমন সব দেশ বা স্বল্পন্নোত দেশগুলোতে উন্নয়ন নিয়েঅনেক কথাবার্তা হচ্ছে ৷ আজকাল উন্নয়ন বিভিন্ন পরিকল্পনা ও নীতিমালার মূল লক্ষ্যেপরিণত হয়েছে ৷ কিন্তু উন্নয়ন বলতে কি বোঝায় এবং কোন কোন মানদন্ড বা দৃষ্টিভঙ্গিরভিত্তিতে তা খুব দ্রুত অর্জন করা সম্ভব? উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি, অগ্রগতি- এ শব্দগুলোপ্রায়ই বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংক্রান্ত লেখালেখি বা আলোচনায় ব্যাপকভাবেব্যবহৃত হচ্ছে৷ অধিকাংশ অর্থনৈতিক গবেষণায় এ শব্দগুলো অনেকটা সমার্থক শব্দ হিসেবেপাশাপাশি ব্যবহৃত হয়৷ প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়ন এ দুই শব্দের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে বলেকোনো কোনো অর্থনীতিবিদ মনে করেন৷ প্রবৃদ্ধি বলতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক ওপরিমাণগত কিছু চালিকাশক্তি বা মানদন্ডকে বোঝানো হয় ৷ যেমন, মাথাপিছু আয়, গড় জাতীয়আয় বা উৎপাদন ইত্যাদি৷ অন্যদিকে উন্নয়ন বলতে এইসব অর্থনৈতিক সূচকের অবস্থা বিবেচনারপাশাপাশি অবকাঠামোগত পরিবর্তনকেও বিবেচনা করা হয়৷ অন্য কথায় উন্নয়নের পরিধি আরোব্যাপক এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়ার রয়েছে বহুমাত্রিক দিক বা বিভাগ৷ একদল অর্থনীতিবিদ মনেকরেন, সম্পদের সুষম ও ন্যায্য বন্টন, দারিদ্র বিমোচন, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যপরিস্থিতি, কাঙিখত শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মানব ও প্রাকৃতিকসম্পদের যথাযথ ব্যবহার এবং জনকল্যাণ-এসবই হলো উন্নয়নের প্রধান কিছু সূচক৷ বিশিষ্টঅর্থনীতিবিদ মাইকেল টডারো বলেছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলো সমাজের সকল স্তরের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন৷

  

টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন

গত কয়েক দশক ধরে ”টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন” শব্দটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেব্যাপক মাত্রায় ব্যবহৃত হচ্ছে৷ টেকসই উন্নয়নের সমর্থকরা পরিবেশ সংরক্ষণকে অর্থনৈতিকউন্নয়নের অবিচেছদ্য অংশ এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় পরিবেশ রক্ষার বিষয়টিও গুরুত্ব পাওয়াউচিত বলে মনে করেন৷ অন্য কথায় তাদের মতে, উন্নয়নের সূচক হিসেবে অর্থনৈতিক ও সামাজিকদিকগুলো ছাড়াও পরিবেশ সংরক্ষণকেও গুরুত্ব দেয়া উচিত৷ কারণ যে উন্নয়নে পরিবেশসংরক্ষণ, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং প্রাকৃতিক অন্যান্য শক্তিকে গুরুত্ব দেয়া হয় না, দীর্ঘমেয়াদে সেই উন্নয়নের কার্যকারীতা থাকে না৷ আর এ অবস্থায় উন্নয়ন টেকসই হয় না৷আবার অনেক বিশেষজ্ঞ উন্নয়ন বলতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন ছাড়াও সাংস্কৃতিকক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জনকেও উন্নয়নের অন্যতম লক্ষ্য বলে মনে করেন৷ কারণ, অর্থনৈতিকসমৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি একইসাথে ঘটলে উন্নয়ন ও নৈতিকতা বা মূল্যবোধগুলোরমধ্যে এক ধরনের পারস্পরিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়৷ অর্থাৎ তাদের মতে, প্রত্যেক জাতিসাংস্কৃতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তার জাতীয় ও ধর্মীয় মূল্যবোধ অনুযায়ী অগ্রসর হবেপশ্চিমা দেশগুলোর বা উন্নত দেশগুলোর সংস্কৃতি অনুযায়ী নয়৷


 অর্থনৈতিক মূল্যবোধে ইসলামের দৃষ্টি

উন্নয়ন সম্পর্কে ধর্মীর্য় চিন্তামুক্ত বিভিন্ন ঘরাণার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনার পর এবার আমরা পবিত্র ধর্ম ইসলামের দৃষ্টিতে উন্নয়ন বলতে কি বোঝায় তা নিয়ে আলোচনা করবো৷ ইসলাম ধর্ম এমন এক ধর্ম যামানুষের সব ধরনের চাহিদার ব্যাপারে সার্বিক বা পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে৷ তাইইসলাম উন্নয়নকেও তার দৃষ্টিসীমার বাইরে স্থান দেয় নি৷ ইসলামের উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গিবিশ্বজগতে মানুষের অবস্থান, এ পৃথিবীতে মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য এবং দুনিয়ার সুযোগসুবিধা বা নেয়ামত ভোগ সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্ভুত৷ ইসলামী নীতিমালাবা শিক্ষার দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে এ শিক্ষায় সরকার ও সমাজের অর্থনৈতিক আচরণ বাতৎপরতা এবং সামাজিক পরিবেশকে এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে যে এর ফলে টেকসই ও কাঙিখতঅর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জিত হয়৷ আর তা ইসলামী সমাজের উচচতর লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্যেইঅর্জিত হয়ে থাকে৷ এখানে মনে রাখা দরকার ইসলামী সমাজে অর্থনৈতিক তৎপরতায় মানবীয় ওনৈতিক মূল্যবোধ বা বিধানগুলোর ভূমিকা রয়েছে৷ আর এ কারণে ইসলামী সমাজে অর্থনৈতিক তৎপরতা গুলো সুস্থ পরিবেশে এবং সঠিক নীতিমালা বা বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হয়৷ পৃথিবীতে পদার্পণের পর থেকেই বা গুহায় বসবাসের যুগ থেকেই মানুষ বেঁচে থাকার জন্যেসমৃদ্ধি অর্জন ও জীবনমান উন্নয়নের চেষ্টা করেছে ৷ এসব প্রচেষ্টার ফলে মানুষেরজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন বা সমৃদ্ধি ঘটেছে৷ কিন্তু বর্তমানে শিল্পোন্নতসমাজের বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রতিবাদ করা হচ্ছে তা হলো, শিল্পোন্নতসমাজগুলো মানুষকে নিজের কাছে আত্মপরিচয়হীন, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা বিবর্জিত এবংমূল্যহীন করেছে ৷

 

নাগরিক অধিকার সোচ্চার

মানুষ এবং সমাজকে নিয়ে সমাজবিজ্ঞানের যে সব সংজ্ঞা আছে তার পুরোটাই এদেশে রক্ষিত হয়। জাত-পাত নিয়ে বিতর্ক, শ্রেণী-বর্ণের বিন্যাস, দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ-বিভাজন, দীন-দ্বীনের অযাচিত প্রশ্ন, জাতিগত তাত্ত্বিক অবমূল্যায়ন এ দেশে নেই। পাশের চেয়ারে বসে আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গরা শ্বেতাঙ্গদের সাথে কাজ করছে। বসবাস করছে। আইরিশ, ভারতীয়, জ্যামাইকান, সোমালিয়ান, ইংরেজ, পর্তুগীজ, নাইজেরিয়ান এবং গ্রীক মিলে ‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভিতরে সবার সমান রাঙ্গা’ কবিতার মত আমরা একটি বিল্ডিং পনরটি পরিবার থাকি। শব্দ করে দরজা খোলা- বাধাঁ, উচ্চস্বরে রেডিও-টিভি বাজানো সরকারী ভাবে নিষিদ্ধ। রাস্তায় তো দূরের কথা, আমরা আমাদের ঘরের ভেতরও যেমন খুশি তেমন করতে পারি না। নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে এ দেশ সব সময় উদার হস্ত। শিখদের মাথায় বৃহদাকার টারবান, মুসলমানদের (বিশেষ করে ইরানীদের) মাথায় ছোটখাট পাগড়ি-টুপি, মাদার তেরেসার অনুসারিদের সেই চির পরিচিত সবুজ ড্রেস, যুবক-যুবতীদের ইচ্ছে মত পোষাক, কাট-ছাট অথবা লম্বা কালারফুল চুল, নানা জাতির নানা বর্ণের, নানান স্টাইলের কাপড়-চোপড়, চলা-বলা কোথাও কারো কোন প্রকার বাধা নেই। পথে-ঘাটে কারো কোন দাদা নেই। চোখে-মুখে কারো কোন বিরক্তিকর ভাব-লেশ নেই। এ দেশে কারো প্রতি চেয়ে কিছু বলা অন্যায় এবং অশোভনীয়।ষোল বছরের পর থেকে একজন ছেলে বা মেয়ে তারা তাদের পোষাক, বাসস্থান বা জীবন সঙ্গী বেছে নিতে পারে। তাদেরকে সরকার সব ধরণের সহায়তা দিতে বাধ্য থাকে। ষোল বছরের আগে কেউ কোন দোকান থেকে সিগারেট, মদ, ঔষধ বা এলকোহল জাতীয় কিছু কিনতে পারে না। কোন দোকানদার তাদের কাছে এসব বিক্রয় করতে বাধ্য নয়। কারো বয়স নিয়ে দোকানদার সন্দেহ পোষন করলে তাকে বয়সের প্রমাণ পত্র দেখাতে হয়। লন্ডনের কিছু কিছু বরা ষোল বছরের কম বয়সী ছেলেমেয়েকে সেখানে প্রবেশের সময় সীমা বেঁধে দিয়েছে। ভোর সকাল থেকে সকাল ৭, এবং বিকাল ৭ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত যদি সে জোনে কেউ থাকতে বা প্রবেশ করতে চায় তাকে পিতামাতার সঙ্গে আসতে হয়। কিছু কিছু এলাকায় লেখা আছে, যেমন ‘এলকোহলমুক্ত জোন’, ‘অপরিচিতদের প্রবেশ নিষেধ’ ইত্যাদি।


 ইসলাম ও অর্থনৈতিক মূল্যবোধ

ইসলামের দৃষ্টিতে উন্নয়ন ওএ সংক্রান্ত কর্মপন্থার ব্যাখ্যা দেয়ার আগে মানুষ, তার জীবন এবং দুনিয়ার নেয়ামত বাসম্পদ সম্পর্কে ইসলামের ব্যাখ্যা বা বক্তব্য শোনা যাক৷ উন্নয়নের ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গীঅনুযায়ী পৃথিবীতে মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি এবং মানুষের উচিত খোদায়ী বিধি বিধানঅনুযায়ী উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির চেষ্টা করা ৷ মানুষ যেসব সম্পদ ভোগ করে, ইসলামেরদৃষ্টিতে সেই সব কিছুর প্রকৃত মালিক হলেন মহান আল্লাহ৷ পবিত্র কোরআনেই এ বিষয়টিউল্লেখিত হয়েছে৷ মহান আল্লাহ পৃথিবীতে বা বিশ্ব জগতে মানুষকে অন্য সব সৃষ্টির চেয়েবেশী মর্যাদা ও সম্মান দিয়েছেন এবং পৃথিবীর সব কিছু মানুষের আওতাধীন করে দিয়েছেনযাতে মানুষ তার প্রতিনিধিত্ব বা দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে৷ এরই আলোকে ইহকাল ওপরকালে মানুষের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার আচার আচরণের প্রকৃতির ওপর ৷ এপ্রসঙ্গে পবিত্র কোরানের সূরা বনি ইসরাইলের ৭০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: ”আমরামানুষকে মর্যাদা দিয়েছি৷ ভূভাগে ও সাগরে তাঁদের জন্যে পরিবহনের ব্যবস্থা করেছি এবংতাদেরকে পবিত্র জীবিকাসমূহ দিয়েছি ও তাদেরকে অনেক সৃষ্টির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব ও অনুগ্রহদান করেছি ৷”  পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে দুনিয়ার নেয়ামতসমূহ মানুষের প্রতি মহানআল্লাহর অনুগ্রহ মাত্র যাতে মানুষ একদিকে তাদের চাহিদাগুলো পুরণ করতে পারে ও এভাবেনিজেকে উন্নত করার সুযোগ পেতে পারে এবং অন্যদিকে তাকওয়া বা খোদাভীরুতা অবলম্বনেরমাধ্যমে কূপ্রবৃত্তিগুলো দমন করতে পারে ৷ সূরা বাক্বারার ১৬৮ নম্বর আয়াতে মহানআল্লাহ বলেছেন, ”হে মানুষ! জমিনে যা কিছু আছে তা থেকে হালাল বা বৈধ ও পবিত্র খাদ্যগ্রহণ কর এবং শয়তানের পদক্ষেপের অনুসরণ করো না, কারণ, সে অবশ্যই তোমাদের প্রকাশ্যশত্রু ৷”

 

রাজনৈতিক-অর্থনীতির পরিভাষা

স্বাধীনতার দীর্ঘ তিন যুগ পরও মর্মন্তুদ সত্য হল আমরা এখনো একটি পশ্চাৎপদ জাতি। যদিও রাজনৈতিক-অর্থনীতির পরিভাষায় আমাদের বলা হয় একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। আমাদের এ পশ্চাৎপদতার মূল কারণ সর্বগ্রাসী দারিদ্র্য। আমাদের এ দারিদ্য্র কেবল বিত্তের নয়, চিত্তেরও। বরং বলা চলে এ দারিদ্র্য যতটুকু বিত্তের, ততোধিক চিত্তের। একদা কবি নজরুল অত্যন্ত আক্ষেপ করে বলেছিলেন আমরা বাঙালিরা কেবল ধনে নয়, মনেও কাঙ্গাল। নজরুলের এ উক্তি বহু বছর পূর্বের হলেও এখনো সমভাবে সত্য কী ধনে, কী মনে, আমাদের এ কাঙ্গালিত্ব ঘুচেনি। বস্তুতঃ চিত্ত ও বিত্তের এ কাঙ্গালিত্বের  কারণে আমরা একটি পশ্চাৎপদ জাতি। আমাদের বিত্তের এ পশ্চাৎপদতার  কারণ আর্থ-সামাজিক; আমাদের চিত্তের পশ্চাৎপদতার কারণ সামাজিক-সাংস্কৃতিক। আমাদের আর্থ-সামাজিক পশ্চাৎপদতার কারণ আমাদের  বিদ্যমান উৎপাদন ব্যবস্থার পশ্চাৎপদতা, পরিণামে আমাদের বিত্তহীনতা। স্বাধীনতার  সূদীর্ঘ সাড়ে তিন দশক পরেও কী শিল্পে, কী কৃষিতে, আমরা উৎপাদন ব্যবস্থার কাক্সিক্ষত বিকাশ ঘটাতে পারিনি। গড়ে তুলতে পারিনি কোন বিকাশমান উৎপাদন ও সুষম বণ্ঠন ব্যবস্থা। অথচ দীর্ঘ স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন চুড়ান্ত পরিণতিতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা জাতিগতভাবে যে চেতনা ও মূল্যবোধ  অর্জন করেছিলাম, একটি সদ্যস্বাধীন জাতির এগিয়ে যাওয়া এবং একটি আধুনিক রাষ্ট্র ও সুশীল সমাজ গঠনের জন্য তা ছিল অত্যন্ত যুগোপযোগী। মধ্যযুগীয় ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের খোলস ভেঙ্গে নৃতাত্ত্বিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বিপরীতে গণতন্ত্র, শোষণহীন সমাজ বিনির্মাণ ও একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ, এসবই ছিল একটি ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে  আমাদের মূল্যবোধের বিবর্তন আমাদের অভাবনীয় অর্জন; ইউরোপীয় জাতিগুলো যা রেনেসাঁর মাধ্যমে অর্জন করেছিল। সে অর্থে বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশককে বাঙালি জাতির রেনেসাঁর দশক বলা অত্যুক্তি হবে না।

  

শারীরিক ও বিনোদনমূলক মূল্যবোধ

গ্রামীণ পরিবেশ থেকেই নিকট অতীত বা এখনকার সুশীল ব্যক্তিদের আগমন ঘটে। শীত মৌসুমসহ অন্যান্য সময় এসব স্কুলকে কেন্দ্র করে নানারকম খেলাধুলা, খড়কুটা বিছিয়ে যাত্রা-জারি, কবিগান, থিয়েটার ইত্যাদি বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের কথা বোধকরি অনেকেই ভুলতে পারবেন না। স্বশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত কবিয়াল-বয়াতির জ্ঞানগর্ভ উপস্থাপনা সত্যি বিস্ময়ের। পিন পতন নীরবতা বজায় থাকতো শ্রোতা-দর্শকদের মাঝে। পৌষ-পার্বণসহ বছরের অন্যান্য সময় গ্রামীণ নারীদের পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যেতো। ধান থেকে চাল করার জন্য গভীর রাত অবদি ঢেঁকির আওয়াজও বোধকরি অনেকের অন্তরে আজও গেঁথে আছে। ঢেঁকি-ছাঁটা-চালের বদলে স্বাদগন্ধহীন কলে-ছাঁটা-চাল খেতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। বর্ণহীন চালের বদলে কতোই না আধুনিক সাদা চাল খাদ্য তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। পিঠা-পায়েসের স্থলে এখন আমরা ফাস্ট ফুড বা বাজার থেকে কেনা নাস্তা দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করছি। কবিয়াল-জারিয়ালদের উপস্থাপনাও সেকেলে হয়ে গেছে। শুধুমাত্র উচ্চশিক্ষিত হওয়ার চিন্তায় বিভোর না হয়ে সত্যিকার জ্ঞানী, সৎ, নিষ্ঠাবান হওয়ার প্রয়াস চালিয়ে গেলে বর্তমান ও পরবতর্ী প্রজন্মের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। এখন যেহেতু সকল ক্ষেত্র থেকে নন্দিত ব্যক্তিদের অন্তর্ধান ঘটে চলেছে সেহেতু আগামী সুস্থ ও সুন্দর মানুষ গড়ার জন্য অতীতের স্মৃতিময় অধ্যায়ের যাবনিকা না টেনে উদাহরণ ও অনুসরণীয় গ্রামীণ প্রতিভাধারীদের যথাযোগ্য মূল্যায়ন করা দরকার।


আমাদের প্রত্যহিক জীবনে শারীরিক ও বিনোদনমূলক মূল্যবোধের অবস্থান

ছোট্টবেলা থেকে আমি আমার সমস্ত খেলার জিনিসসহ আরও অনেক কিছু সংগ্রহ করেছি, যা দিয়ে বাবা-মা আমাদের জন্য একটি খেলাঘর বানিয়ে দেন। আর সেই খেলার ঘরকে নিয়ে আমাদের দু’বোনের সময় কেটে যায়। যখন যেখানে গিয়েছি সেখানেই আমাদের জন্য একটি খেলাঘর বানিয়ে দেয়া হয়েছে। এক সময় এটাই আমার প্রিয় শখ, প্রিয় বিনোদনের জায়গা হয়েছে। এই যে এত বড় হয়েছি এখনো সেই খেলাঘর রয়েছে যা অবসরে আমাকে আনন্দ দেয়। এখন এটা পড়ার কক্ষ, বিশ্রামের কক্ষ এবং অমাদের দু’বোনের স্বপ্নের পৃথিবী। কেউ বলে জাদুঘর। এভাবে প্রত্যেক বাবা-মা যদি শিশুদের জন্য ঘরের এক কোণায় কিংবা বেলকনিতে বিনোদনের বা খেলার জন্য একটি বিশেষ জায়গা তৈরি করে দেন কিংবা শিশুদের যদি একটি বিশেষ শখের প্রতি আগ্রহী করে তোলা যায় তাহলে দেখা যাবে অনেক শিশুই বর্তমানের এই বন্দি ও একাকিত্ব থেকে মুক্তি পাবে। এবং সেই বিশেষ শখটিকে ঘিরে তার সময় কেটে যাবে। এজন্য প্রয়োজন শুধু বাবা-মায়ের সচেতনতা। শিশুর মানসিকতাকে বোঝা। শিশুর কোন্ বিষয়ের প্রতি আগ্রহ রয়েছে সেদিকে লক্ষ্য রেখে বিচক্ষণতার সঙ্গে তাকে পরিচালিত করা। আসুন একটি সুন্দর, সুস্থ পরিবেশে শিশুদের গড়ে তুলি।


সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে

কোনো দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন তখনই সম্ভব যখন তার জনসাধারণকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যায়। শৈশবই সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার প্রকৃষ্ট সময়। আজকের শিশু আগামীদিনের ভবিষ্যৎ। আজকের যে শিশুটি সুনাগরিক হবার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে চললো তার কাছ থেকে দেশ, জাতি বা সমাজ ভালো কিছু প্রত্যাশা করতে পারে না। তাই পরিবারসহ সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে শিশুদেরকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে। সুনাগরিক হবার শিক্ষা শিশু সমভাবে পাবে স্কুল, সমাজ এবং পরিবার থেকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, অনেক শিশুই তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পায় না, যা সামাজিক অস্থিরতায় অবদান রাখে। শিক্ষক হবার সুবাদে অনেক শিশু-কিশোরের মধ্যেই যে সব নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে তা হতাশাব্যঞ্জক এবং তাতে করে পারিবারিক ঔদাসীন্যের বিষয়টি বিশেষভাবে ফুটে ওঠে। শত ব্যস্ততার মধ্যেও শিশুর বাবা-মা কিংবা অভিভাবক যদি দিন শেষে একটু খোঁজ নেন যে শিশুটি ক্লাসের পড়াটা শিখেছিল কিনা, মিথ্যে বলেছে কিনা, কারো সঙ্গে অসদাচরণ কিংবা বেয়াদবি করেছে কিনা, কারো গায়ে হাত তুলেছে কিনা, পাগল কিংবা পাখপাখালি, জীব-জন্তুর প্রতি ঢিল ছুড়েছে কিনা, কাউকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছে কিনা, তবে তা শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশে যথেষ্ট সহায়ক হতে পারে। অনেক কিশোরের আচরণ দেখে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, পারিবারিক শিক্ষণের অভাব রয়েছে। ইউনিফর্ম ঠিক না থাকা, আপত্তিকর চুলের স্টাইল, অশালীন স্টাইলে পোশাক পরা, অশস্নীল ভাষা প্রয়োগ, সহপাঠীর কাঁধে হাত রেখে ক্লাসে বসে থাকা, ক্লাসে গোলমাল করা, বেঞ্চে পা তুলে বসা, শিক্ষকের নাম ধরে ডাকা, শিক্ষকের সমালোচনা করা, বয়োজ্যেষ্ঠদের সালাম না দেয়া, ক্লাসে কিংবা বারান্দায় থুতু ফেলা, স্কুেলর দেয়াল, বাথরুম কিংবা বেঞ্চে অশালীন লেখাজোখা করা, অপরিণত বয়সে মোবাইল, সিডি নিয়ে ঘোরা, পথেঘাটে দল বেঁধে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা প্রভৃতি কোনো মতেও সুনাগরিকের লক্ষণ নয়।


শারীরিক ও মানসিক বিকাশ

পারিবারিক, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক ঔদাসীন্যের ফাঁক-ফোকরে অনেক শিশুই সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার পথ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ক্রমশ। সুস্থ বিনোদনের অভাব, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অভাব চোখে পড়ার মতো। অধুনা গ্রামের শিশুরাও দিনভর মাথা ঝুঁকে থাকছে ডিশ এন্টিনায়। ব্যাহত হচ্ছে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ। এখনই সতর্ক না হলে একদিন যথেষ্ট মূল্য দিতে হবে আমাদের। এ বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে শিশুর জীবন ঘিরে আবর্তিত সমাজের প্রতিটি সচেতন মানুষকে। দীক্ষা নিতে হবে দেশের প্রতিটি শিশুকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার। নইলে সুখী সমৃদ্ধ সুশৃংখল সমাজের চিন্তা হবে দুঃস্বপ্ন মাত্র। উঁচু ঘরবাড়ি, দামী বেশভূষা, সুখাদ্য সুগন্ধি হবে নামমাত্র, খোলস সর্বস্ব।


শিশুর এককিত্ব থেকে মুক্তি পেতে

আমাদের জীবনযাত্রা এত বেশি যান্ত্রিক হয়ে গেছে যে সেখানে অবসর বলতে কিছু নেই। নেই বিনোদনের জন্য কোনো সময়, যার প্রভাবটা পড়ছে শিশুদের ওপর। একদিকে রাশি রাশি দালানকোঠায় খেলার বা বিনোদনের জায়গা নেই। অন্যদিকে বাবা-মাও হয়তো সময় দিতে পারছেন না তাদেরকে। ছোট্টবেলা থেকেই যদি শিশুদের কোনো একটি বিশেষ শখের প্রতি আগ্রহী করে তোলা যায় তাহলে হয়ত শিশুরা এককিত্ব থেকে কিছুটা মুক্তি পেতে পারে। যেমন আমার বাবা-মা চাকরিজীবী। চাকরির সুবাদে আমাদের অনেক জায়গাতে যেতে হয়েছে, মানিয়ে নিতে হয়েছে সেই বন্দি এবং একাকী জীবন। কিন্তু আমরা নিজেদের কখনো বন্দি বা একাকী মনে করিনি, তার কারণ বাবা-মা আমাদের একটা বিশেষ শখের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিলেন। আর সেটা হল নিজেদের পছন্দের ছোট ছোট জিনিস সংগ্রহ করা এবং তা দিয়ে একটি ছোট্ট সংগ্রহশালা তৈরি করা। এভাবে সেই


চাকচিক্যময় জীবন প্রবাহ

ইদানীং মিডিয়াতে সুশীল সমাজের কেউ কেউ অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে নতুন প্রজন্মের জন্য মডেল উপস্থাপন করছেন। তরুণ সমাজ এসব বিষয়ে খাটো করে না দেখে আদর্শগত দিককে গ্রহণ করলে পূর্ববতর্ীদের ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব খুঁজে পেতে পারে। গ্রামীণ পর্যায় থেকে উঠে আসা ব্যক্তিরাই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা প্রচার করতে পারে। অবশ্য ব্যতিক্রমধমর্ী কিছু লোক সাধারণ পরিবেশ থেকে নগরজীবনে বিত্তশালী হয়ে চাকচিক্যময় জীবন প্রবাহে শেকড়ের কথা ভুলে যায়। গ্রামীণ খেলাধুলা_ হাডুডু, দাঁড়িয়াবান্ধা, কানামাছি, নৌকা বাইচ বা কর্দমাক্ত মাঠের খেলাধুলার মধ্যে কতোই না বিচিত্র স্বাদ পাওয়া যেতো। হাতেগোনা কিছু স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি-শিক্ষকরা কতোই না উন্নত মনের অধিকারী ছিলেন। যেমন বরিশাল জেলার বাদলপাড়া জুনিয়র হাইস্কুলের ম্যানেজিং কমিটির প্রধান এছহাক হাওলাদারকে দেখেছি প্রায় প্রতিদিন নিজ হাতে কাঠমিস্ত্রির প্রাথমিক কাজ করে ছাত্রদের বেঞ্চগুলো বসার উপযোগী করে রাখতে। আদর্শবান এই ব্যক্তির একমাত্র ছেলেও পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে গেছেন। স্কুলের সহকারী শিক্ষক গণেশ বাবু প্রায় সব বিষয়ে ছাত্রদের শিক্ষাদান করতেন। প্রাইমারির রওশন স্যার নিজ হাতে বিশ্বমানচিত্র অঙ্কনসহ ভূগোলক তৈরি করে সবাইকে অবাক করে দিতেন। এসব ব্যক্তির নিঃস্বার্থ শিক্ষার সূত্র ধরে বহু প্রতিভা দেশ ও সমাজের প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এ-রকম স্কুল দেশের প্রায় সর্বত্রই ছিল এবং


বৃদ্ধাশ্রম

পৃথিবীতে এখনও কিছু সংখ্যক হূদয়বান ও ভালো মানুষ আছেন, যাঁরা অসহায়, অক্ষম, নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষকে কাছে টেনে নেন। এর একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো গাজীপুরের মনিপুর বিশিয়া বৃদ্ধাশ্রমটি। বাইরের কোনো সাহায্য বা অনুদান ছাড়া খতিব আবদুল জাহিদ মুকুল তাঁর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আয়ের অর্ধেক অংশ দিয়ে এ বৃদ্ধাশ্রমটি সযত্নে পরিচালনা করে আসছেন। বৃদ্ধাশ্রমে প্রায় ১০০০ বৃদ্ধ-বৃদ্ধার থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। জানা যায়, প্রতিদিন তিনি নিজেই তাদের ভালোমন্দের খোঁজখবর নেন এবং মহানুভব ব্যবহার করেন যাতে করে আশ্রিতদের মনে কোনো দুঃখ-বেদনা না থাকে। বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্তের প্রকৃত অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের এখানে থাকার সুযোগ রয়েছে। অবশ্য বয়স ৬০ বছর হতে হবে। যে কোনো ধর্মের অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের যিনি পেঁৗছে দেবেন, ঐ ব্যক্তির যাতায়াত খরচ দেয়া হয়ে থাকে। পুনর্বাসন কেন্দ্রে ফোন করে জানালেও সংশিস্নষ্ট বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয় বলে জানা গেছে। এখানে খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসার যাবতীয় খরচ প্রতিষ্ঠান থেকেই ব্যয় করা হয়। চাহিদা অনুযায়ী এদের কাপড়-চোপড়সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ফ্রি দেয়া হয়। এতে করে শেষ জীবনে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ভালোভাবেই দিনযাপন করেন। পত্রিকান্তরে জানা যায়, পবিত্র ঈদুল আজহায় ২/১ দিন আগে অর্ধশত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পুনর্বাসন থেকে প্রাণের টানে ছুটে গিয়েছিলেন ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে ঈদের দিনটা একসঙ্গে কাটাতে। কিন্তু তাদের মধ্যে ৪৫ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ঐ দিনই বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে পুনরায় ফেরত আসেন চোখের পানি ফেলতে ফেলতে। তাদেরকে গ্রহণ করা তো দূরের কথা বরঞ্চ নিজ বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হয়নি। বিষয়টি বৃদ্ধাশ্রমের কর্মকর্তাদের গোচরে পৌঁছলে ঈদের দিন বিশেষ খাবার আয়োজন করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মধ্যে পরিবেশন করা হয়। শুধু তাই নয়, তাদের থাকার কক্ষগুলোকে নানা রঙের কাগজ দিয়ে সাজানো হয়। এটা একটা প্রশংসনীয় কর্মই বটে। প্রতিষ্ঠাতার এই বদান্যতা ও উদ্যোগের জন্য তাঁকে আন্তরিক সাধুবাদ জানাই।


মানবাধিকার রক্ষায় প্রতিবন্ধী

সামাজিকভাবে ধিকৃত-বিকৃত ও অবহেলিত মানুষ যাদেরকে প্রতিবন্ধী বলে পরিচয় দিলেও একজন নাগরিকের সর্বপ্রকার অধিকার তাদের প্রাপ্য। মানবাধিকার রক্ষায় প্রতিবন্ধীদের সম-অধিকার রয়েছে এবং তাদের বাদ দিয়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। জাতিসংঘ কর্তৃক পরিচালিত এক সমীক্ষায় জানা যায় বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০% লোক কোন না কোনভাবে প্রতিবন্ধী, যদি পুরোপুরি হিসাব করা যায় এই সংখ্যা ২৫% ভাগে উন্নীত হতে পারে। এ সমীক্ষায় আরো জানা যায় যে উন্নয়নশীল দেশে ৮০% প্রতিবন্ধী গ্রামে বাস করে। প্রতিরোধ ও নিরাময়ের জন্য পদক্ষেপের অভাবে এ হার বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তিবন্ধী ব্যক্তি বলতে দুর্ঘটনা, চিকিৎসাত্রুটি বা জন্মগতভাবে কোন ব্যক্তির যদি শারীরিক বা মানসিক অবস্থার ক্ষতি হওয়ার মাধ্যমে কর্মক্ষমতা আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে লোপ পায় তাকে বুঝায়। প্রতিবন্ধী মূলতঃ শারীরিক মানসিক দৃষ্টি শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের ক্ষতির কারণে হয়ে থাকে। মৃদু, মাঝারি এবং চরম প্রকার প্রতিবন্ধিতার প্রকোপ দেখা যায়। কোন ব্যক্তির হাত বা হাতের অংশ না থাকলে, হাত পূর্ণ বা আংশিক অবশ থাকলে, পা বা পায়ের কোন অংশ না থাকলে, পা বা অবশ ও শক্তিহীন থাকলে শারীরিক গঠন বিকৃত হলে মসিত্মষ্ক সংক্রানত্ম সমস্যার জন্য শারীরিক গঠন বিকৃত হলে মস্তিষ্ক সংক্রান্ত সমস্যার জন্য শারীরিক স্বাভাবিক ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা স্থায়ীভাবে ক্ষতি হলেই শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়। মানসিক প্রতিবন্ধীরা বয়োবৃদ্ধির সাথে বুদ্ধিবৃত্তির পূর্ণতা ও স্বাভাবিক বিকাশ লাভে ব্যর্থ এবং বয়সের তুলনায় কমবয়সীদের মত আচরণকারীকে বুঝায়। যারা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী তারা একেবারে দেখতে পান না, এক চোখে দেখতে পায় না, লেন্সের মাধ্যমেও যদি কারো ভিজ্যুয়াল ঐ্যকুইটি ৬/৬০ বা ২০/২০০ (লেন্সের পদ্ধতি) অতিক্রম না করে, ফিল্ড অর ভিশন যদি ২০ ডিগ্রি কোণের বিপ্রতীপ কোণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে তাকেই বুঝায়। আবার শ্রবণ বা বাক প্রতিবন্ধী যারা তাদের শ্রবণ ক্ষমতা কম্পাংকের কথোপকথন সীমা ৪০ ডেসিবল বা অধিক হয় এবং যে ব্যক্তির শব্দ উচ্চারণ ক্ষমতা নেই বা উচ্চারণ অস্পষ্ট থাকে।


সুযোগের সমতা বিধান

সমাজের প্রতিটি সত্মরে বিশেষ করে পল্লী এলাকায় এবং শহরের বসিত্ম অঞ্চলে সমাজভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কার্য মা ও শিশুদের জন্য উপযুক্ত ও পুষ্টিকর খাবার জোগান, সংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, নিরাপদ যাতায়াত বিধি স্বাস্থ্যনীতি, শিক্ষা বিষয়ক জীবন ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে এবং যেন প্রতিবন্ধিতার কারণগুলোর বিরুদ্ধে সর্বাধিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়। সমাজ জীবনে প্রতিবন্ধীরা আমাদেরই আপনজন, স্বাভাবিক মানুষের অধিকার তারাও সমানভাবে প্রাপ্য। প্রতিবন্ধীকে সমাজের বোঝা হিসেবে মনে না করে তাদের প্রতি সহনশীল ভূমিকা রাখা প্রত্যেকের প্রয়োজন। যাতে প্রতিবন্ধীরা অন্য সবার মতো সকল নাগরিক অধিকার ভোগ করতে পারে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা স্বাধীনভাবে বসবাস ও সামাজিক পরিবেশ অবস্থান করার ক্ষেত্রে কোন রকম বৈষম্য কাম্য নয় “সুযোগের সমতা বিধানের” আলোকে প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রতিবন্ধীদের বিকশিত করার সুযোগ দেওয়া দরকার। প্রতিবন্ধীরা যাতে বসতি স্থাপনে পরিকল্পনা প্রবেশাধিকার পায় তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন, সর্বোপরি সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এদের জন্য আয় সংরক্ষণে কর্মক্ষম ও নিরাপত্তা সৃষ্টির উদ্যোগ প্রয়োজন-এ জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নীতিমালার অনুসরণ দরকার। শিক্ষা জীবনমান উন্নয়নের একমাত্র মাধ্যম। শিক্ষার মাধ্যমে মানব সমাজ দক্ষতা অর্জন করে বিকাশ লাভ করে। প্রতিবন্ধীদের জন্য সমাজের মূল স্রোতধারায় সাধারণ স্বাভাবিক ও নিয়মিত প্রচলিত শিক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষার ব্যবস্থা উপযোগী পরিবেশ, সহায়ক উপকরণ সরবরাহ ও যথাযথ প্রশিক্ষিত বিশেষ শিক্ষকের মাধ্যমে শিক্ষা দান এবং প্রতিবন্ধীরা যাতে কোন ধরনের প্রতিকূল ও নেতিবাচক আচরণের প্রভাব বা বিরূপ পরিবেশের প্রতিক্রিয়ায় পতিত না হয় সেজন্য সকল ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাহলেই প্রতিবন্ধীরাও শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক, শারীরিক ও বিনোদনমূলক মূল্যবোধকে শ্রদ্ধা করতে শিখবে।


প্রাসঙ্গিক সকল ক্ষেত্রে শিশুর অধিকার

পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রাসঙ্গিক সকল ক্ষেত্রে শিশুর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করা একান্ত আবশ্যক। শিশুর সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা ও অধিকার সংরক্ষণের মাধ্যমে একটি সৎ, দেশপ্রেমিক ও কর্মক্ষম ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার যত্নশীল ও সক্রিয়। বাংলাদেশের ১৮ বছরের কম বয়সের জনসংখ্যা ৬ কোটি ৩০ লক্ষ যা মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ। মানব সম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে যা বিভিন্ন মানদন্ডের বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয়। শিশু এবং মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাসে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ও সাফল্য অর্জিত হয়েছে। শিশু মৃত্যুহার হ্রাসে সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের সাফল্যের জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে UN Millennium Award 2010 প্রদান করা হয়। সম্প্রসারিত টিকা প্রদান কার্যক্রমের (EPI) আওতায় শতকরা ৮৭ ভাগ শিশুকে আনা হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে জেন্ডার সমতা অর্জিত হয়েছে যা সহস্রাব্দের লক্ষ্যমাত্রা (MDG-3) পূরণ করেছে। বিদ্যালয় থেকে শিশুদের ঝরে পড়ার হার হ্রাস করার লক্ষ্যে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে। শিশু অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দারিদ্র প্রধান অন্তরায়। বৃহৎ অংশের  শিশুদের দারিদ্র বিমোচন, পুষ্টি, স্বাস্থ্য সেবা, নিরাপদ আশ্রয়, পয়ঃনিষ্কাশন ইত্যাদি সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে সরকার বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল শিশুদের পুনর্বাসন, পর্যায়ক্রমে শিশু শ্রম নিরসন, শিশুদের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যবহার বন্ধ করা ও তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে শিক্ষা ও বিনোদনের উপযুক্ত সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে বিভিন্ন কার্যক্রম।


শিশু স্বাস্থ্য আইনে

সকল শিশুর জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সম্প্রসারিত টিকা প্রদান কার্যক্রম (EPI), শৈশব-অসুস্থতার সমন্বিত ব্যবস্থাপনা (IMCI) ও নবজাতক স্বাস্থ্য (NBH), প্রজনন স্বাস্থ্য, যৌন সংক্রামক ব্যাধিসমূহ, HIV/AIDS প্রতিরোধসহ সময়োপযোগী অন্যান্য কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মী এবং চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং দক্ষ ধাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত করা হবে। বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মৌলিক তথ্য অন্তর্ভূক্তির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। শিশুর অধিকার এবং মা ও শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষার উপায় সম্পর্কে  সারাদেশে তৃণমূল পর্যায়ে নিয়মিত অবহিতকরণ কর্মসূচি পরিচালনা করা হবে। শিশুদের জন্য নিরাপদ পানির উৎস সুলভ রাখা এবং লবনাক্ত উপকূলীয় এলাকা ও আর্সেনিকযুক্ত পানির এলাকায় বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ হবে। বিদ্যালয়ে শিশু বান্ধব পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা স্থাপন ও পানীয় জলের সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। কন্যা শিশু ও কিশোরীদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে আলাদা পয়ঃ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। শিশুর আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকে ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে সর্বজনীন মানবিক বৃত্তির সুষ্ঠু বিকাশের  পরিবেশ নিশ্চিতকরণের উদ্যোগ গ্রহণ এবং প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম শক্তিশালী ও সম্প্রসারিত করা হবে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র চালু করত এসব কেন্দ্রের শিক্ষকদের মৌলিক প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। ৩-৫বছর বয়সী শিশুদের জন্য শিশু বিকাশ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।


স্বাস্থ্য শিক্ষা

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় উদ্ভিদের প্রতি মানুষের নির্ভরশীলতা প্রাচীনকাল থেকেই। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার সাথে সাথে আমাদের দেশে হারবাল চিকিৎসার যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ। কিনতু এখানকার গ্র্যাজুয়েটদের যথাযথ মূল্যায়ন না করা, সরকারের সঠিক নীতির অভাব ও লোকবল সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে এ কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য। ঢাকার মিরপুর-১৩ নম্বর সেকশনে অবস্থিত সরকারি ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত । দেশে হারবাল মেডিসিনের একমাত্র সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। চিকিৎসা ব্যবস্থা সহজলভ্য করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শে ও প্রায় ১৪ কোটি টাকা অর্থায়নে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৯-১৯৯০ শিক্ষাবর্ষ থেকে এই কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্র: এখান থেকে পাসকৃত ডাক্তারগণ ভারত, কানাডা, চীন, জাপান, ইউকে ও আমেরিকাসহ কয়েকটি দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে পারেন। ভাল রেজাল্ট থাকলে স্কলারশিপও পাওয়া যায়। এছাড়া দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল, পিএইচডি করা যায়। এই কলেজ থেকে পাস করে ব্যক্তিগতভাবে ডাক্তারি পেশা ছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির ক্ষেত্র রয়েছে। সাধারণ ক্যাডারে বিসিএস পরীক্ষাও দেয়া যায়। বর্তমানে ৬৪টি জেলা সদর হাসপাতালের মধ্যে ৪৫টিতে অল্টারনেটিভ মেডিকেল অফিসার (এএমও) হিসেবে এখানকার পাসকৃত শিক্ষার্থীরা চাকরি করছেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে একজন করে অল্টারনেটিভ মেডিকেল অফিসার (এএমও) পদ তৈরি ও নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ইতিমধ্যে ১৫৩টি উপজেলায় পদ তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া প্রায় অধিকাংশ ফার্মাসিউটিক্যালে আয়ুর্বেদিক ঔষধ তৈরি শুরু করেছে। যেমন-স্কয়ার, ইবনে সিনা, একমি, বায়োফার্মা, হামদর্দ, নেপচুন, এসকেএফ, জেসন, মডার্ণ হার্বাল, গ্রীণ ফার্মা ইত্যাদি। এসব জায়গায় মেডিকেল অফিসার ও প্রোডাকশন অফিসার হিসেবে কাজের সুযোগ রয়েছে।


সরকারের পদক্ষেপসমূহ

চলতি বছরের গোড়ার দিকে এ গ্রামের কয়েকজন সমাজসেবী ও ভবিষ্যতের স্বপ্নদ্রষ্টাদের সমন্বয়ে গঠিত বিশ্বাস ফাউন্ডেশন সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের রেজিস্টেশনভুক্ত একটি অরাজনৈতিক, অলাভজনক, অসাম্প্রদায়িক ও বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী উন্নয়ন সংস্থা। যার রেজিস্ট্রেশন নং কুশ ৮৯৯/১০। এ সংস্থার মূল উদ্দেশ্য এদেশের জনগণের স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করাসহ এ সমিতির সব সদস্য ও এলাকাবাসীর মধ্যে সার্বিক সহযোগিতা, সৌহার্দ্য ও ভাতৃত্ববোধ সুদৃঢ় করা। বিশ্বাস ফাইন্ডেশনের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য

১. গ্রামীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধিরোধে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির বাস্তবায়ন।

৩. নারীর ক্ষমতায়ন।

৪. মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সামাজিক নিরাপত্তা বিধান করা।

৫. উন্নত স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা।

৬. গ্রামীণ ছাত্রছাত্রীদের সুশিক্ষায় উৎসাহিত করার লক্ষ্যে মেধা পুরস্কার প্রদান।

৭. অতিদরিদ্র, দরিদ্র, মুক্তিযোদ্ধা, বিধবা, বয়স্ক ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান।

৮. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে জনসাধাণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা।

৯. শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হতে বিরত রেখে বিনোদনমূলক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা।

১০. কুষ্টিয়া জেলা আর্সেনিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হওয়ায় গ্রামীণ জনগণকে আর্সেনিক প্রতিরোধে গণসচেতনতা বৃদ্ধি ও আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

১১. ইভটিজিং প্রতিরোধে স্কুল ও কলেজভিত্তিক গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পোস্টার, স্টিকার, বুকলেট প্রভৃতি প্রচারপত্র প্রকাশ এবং বিতরণ করা।

১২. কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষকদের মাঝে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির প্রদর্শন ও ব্যবহার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা।

১৩. গ্রামীণ মহিলাদের কারিগরি ও হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ, কাঁচামাল সরবরাহ ও বাজারজাতকরণের সহায়তা করা। ১৪. গ্রামের মানুষের জরুরি অবস্থায় রোগী পরিবহন জন্য নিজস্ব এম্বুলেন্স চালু করা।

১৫. ঢাকা হতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নিয়ে গিয়ে উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রদান করা।

১৬. তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গ্রামীণ বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা তৈরির লক্ষ্যে তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন।

১৭. অসহায়, অনাথ, এতিম, শিশু, প্রতিবন্ধী এবং অপরাধী সংশোধন ও পুনবার্সন কেন্দ্র স্থাপন।

১৮. ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা।


বেসরকারী ফাউন্ডেশনের হসপিটাল

কিছু বেসরকারী ফাউন্ডেশনের হসপিটাল স্থাপন করে এর বহির্বিভাগ চালু করে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান শুরু করেছে। পাশাপাশি হাসপাতালটির পূর্ণাঙ্গ নির্মাণ ও সেবার কাজ চলছে।

১. প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পরিচর্যা।

২. শিশু স্বাস্থ্যসেবা।

৩. পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে পরামর্শ।

৪. প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে পরামর্শ।

৫. যৌন স্বাস্থ্য সম্পর্কে পরামর্শ।

৬. নিরাপদ মাতৃত্ব সম্পর্কে পরামর্শ ও

৭. টিকা দান।

৮. বিশ্বাস ফাউন্ডেশনের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের বৈশিষ্ট্যগুলো

৯. পরিছন্ন গ্রামীণ পরিবেশ।

১০. অভিজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা সেবা প্রদান।

১১. উন্নত স্বাস্থ্যসেবা।

১২. বিনামূল্যে/ সুলভমূল্যে সেবা ও ওষুধ প্রদান এবং

১৩. রোগীর অবস্থা বুঝে প্রয়োজনে উন্নত হাসপাতালের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা।

সেবাগ্রহণকারীকে অবশ্যই স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্পের সদস্য হতে হবে। শুধু হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী যারা প্রচলিত স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে ব্যর্থ তারাই কেবল সদস্য হতে পারবেন।


শিশু উন্নয়ন

দারিদ্র্য দূরীকরণের অনেকগুলো কৌশলের মধ্যে শিশু উন্নয়ন একটি। এদেশে শিশু উন্নয়নের পথে বাধা হিসেবে কাজ করে অপুষ্টি, রোগবালাই, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, নিপীড়ন, শোষণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সংবিধান ১৯৯০ সালের অনুমোদন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার শিশু উন্নয়ন ও অধিকার রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।  স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, পুষ্টি সেবা, নিরাপদ পানি এবং পয়ঃব্যবস্থা ইত্যাদিতে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। অগ্রগতি আরও হয়েছে শিশু মৃত্যু হারে, টিকা দানে। বাংলাদেশের ৯৮% লোকের জন্য নিশ্চিত করা হয়েছে নিরাপদ খাবার পানি। দুর্ভিক্ষ, খরা, সাইক্লোন, টর্নেডো এবং নদীক্ষয়ের কারণে দুর্দশাগ্রস্ত শিশুদের জন্য প্রদান করা হয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যে সব কাজ করা হবে সেগুলো হলো পোলিও নির্মূল, হাম ও নবজাতকের ধনুষ্টংকার দূরীকরণ, পুষ্টির মান বৃদ্ধি ও বিদ্যালয় স্বাস্থ্য কার্যক্রম জোরদারকরণ। এর উদ্দেশ্য হলো নবজাতক ও ৫ বছরের নিচে শিশুদের মৃত্যু হার কমানো শিশুদের ঐবঢ়-অ, ঐবঢ়-ই, কমানো ও শতকরা ৯০ ভাগ শিশুকে টিকাদান কার্যক্রমের আওতায় আনা।

ক) স্বাস্থ্য ব্যয়ের ক্ষেত্রে দক্ষতা সর্বোচ্চকরণ ও মিতব্যয়ীতা

খ) নবজাতক স্বাস্থ্য পরিচর্যা জোরদারকরণ

গ) স্কুল পর্যায়ে স্বাস্থ্য সচেতনতা

ঘ) কৃমি দূরীকরণ

ঙ) মেয়েদের মধ্যে আয়রণ ও ফলিক এসিড ট্যাবলেট বিতরণ

চ) কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য উন্নয়নে কাউন্সেলিং ও সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কর্মসূচি।

দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ীভাবে বিনিয়োগের মাধ্যমে পুষ্টিহীনতা কমানো ও খাদ্য নিরাপত্তার প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় খাদ্য পরিবহণ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও প্রযুক্তি চিহ্নিতকরণ এবং আইন ও মাননিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির প্রবর্তন। রাতকানা প্রতিরোধে ভিটামিন-‘এ’ এর অভাব দূরীকরণ, আয়োডিন ঘাটতি পূরণে লবণে আয়োডিন মিশ্রণ, আয়রণ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণে উৎসাহ। ৬-২৩ মাস বয়সী শিশু, গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মায়েদের স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্বারোপ, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সমস্যা সমাধানে একটি কর্মকৌশল তৈরি। গণমাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি। শিশু শিক্ষার উপকারিতা সম্পর্কে বাবা-মাকে বুঝানো, স্কুলে ছাত্রসংখ্যা বাড়ানো, ড্রপ-আউট কমানো, সব প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান, ক্লাসে ছাত্র উপস্থিতির হার বাড়ানো, ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো, ক্লাসে ছাত্র সংখ্যা ৪৬ এর মধ্যে রাখা এবং ডেন্ডার সমতা রক্ষা। প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার কৌশল, শিক্ষক ও শিক্ষা উপকরণের মান বৃদ্ধি। আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার মানোন্নয়ন। পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ২০১১ সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যকর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সচেতনতা বৃদ্ধি, সব কূপ পরীক্ষা, প্রতি বাড়িতে পাকা পায়খানা স্থাপন, নিরাপদ পানির ব্যবস্থা। পরিবেশগত সমস্যা যেমন_ উচ্চ শব্দ, বায়ু দূষণ, পানি দূষণ কমিয়ে শিশুদের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা। শিশুদের ক্ষমতায়ন ঘটাতে হবে এবং পরিবারে ও সমাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ থাকা উচিত। এ জন্য সব শিশুর একটি জাতীয় প্ল্যাটফরম থাকতে হবে যেখানে তারা তাদের প্রয়োজন প্রত্যাশা ও তা পূরণের উপায় সম্পর্কে কথা বলতে স্কুলসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে এবং বিভিন্ন তথ্যের মাধ্যমে তাদের চিন্তাভাবনা সমৃদ্ধ করতে হবে, যাতে তারা নিজেরাই নিজেদের মতামত দিতে পারে। সব শিশু বিশেষ করে যারা দুর্বল, সব ধরনের নির্যাতন, শোষণ ও হিংস্রতার হাত থেকে তাদের রক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এ সম্পর্কিত সব প্রকার আইনের সমন্বয় করে তা প্রয়োগ করতে হবে। এ ব্যাপারে আইন প্রয়োগকারী ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা, সমাজকর্মী এবং সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।


মানুষের সামগ্রিক জীবনমান উন্নয়ন

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীতে সরকার গৃহীত বিভিন্ন কর্মকাণ্ড আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচনা করতে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরে সরকারের নেয়া বিপুল কর্মসূচী প্রানত্মিক জনপদে সাধারণ মানুষের সামগ্রিক জীবনমান উন্নয়ন নিশ্চিত করবে। একই সঙ্গে ফিরিয়ে আনবে সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়ন ঘটাবে ক্রমাগত অভাবের কারণে অবনমনশীল সামাজিক মূল্যবোধের। চলতি অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের পরিধি বৃদ্ধিসহ এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছে সরকার। এবারের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের তুলনায় এবার সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে সহস্র কোটি টাকা। এ বরাদ্দের তাৎৰণিক কোন প্রভাব দৃশ্যমান না হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, সামর্থ্যহীন মানুষের জীবনধারণ মানোন্নয়ন, সামাজিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতিসঞ্চার, শহরমুখী জনস্রোত হ্রাস, অনাহারী মানুষের খাদ্যের নিরাপত্তা, মৌলিক চাহিদাবঞ্চিত হতভাগ্য মানুষের নূ্যনতম অধিকারের গ্যারান্টি, সমাজে অবহেলিত প্রতিবন্ধী-বিধবাদের ঘুরে দাঁড়ানোর নিশ্চয়তা প্রদান করবে। বিশেষভাবে উলেস্নখ্য, প্রধানমন্ত্রী প্রশাসনের প্রথম মেয়াদে তিনি দেশে ‘সামাজিক নিরাপত্তার’ ধারণা বাজেটের অনত্মর্ভুক্ত করেন। সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের কারণে প্রথম মেয়াদে তাঁর সরকারের সময় দেশের মানুষের গড় আয় বেড়ে যায়। বর্তমান মহাজোট সরকার গতবারের তুলনায় এবার সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের বিভিন্ন ৰেত্রে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে এসব ৰেত্রের পরিধিও সম্প্রসারিত করেছে। অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিতে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের পরিধি বাড়ানো এবং ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি দেশকে ‘জনকল্যাণ রাষ্ট্র’মুখী করেছে। সামাজিক নিরাপত্তা ও ক্ষমতায়ন খাতে নেয়া সকল কার্যক্রম অব্যাহত রেখে ২০১০-১১ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা ও ক্ষমতায়ন খাতে ১৯ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রসত্মাব করা হয়; যা উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন বাজেটের প্রায় ১৪.৮ শতাংশ এবং যা জিডিপির ২.৫ শতাংশ।


সামাজিক মূল্যবোধ

সমাজ কাঠামোর অপরিহার্য উপাদান হলো মূল্যবোধ। মানুষের সামাজিক সম্পর্ক ও আচার-আচরণ প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য সব সমাজের বিভিন্ন ধরনের বিধি-নিষেধ থাকে। তবে এসব বিধি-নিষেধ ছাড়াও প্রতিটি সমাজের স্বতন্ত্র মূল্যবোধ থাকে। সেগুলো মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত আচার-আচরণকে পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন ধরনের মূল্যবোধকে আশ্রয় করেই মানুষকে সমাজে বাস করতে হয়।

সামাজিক মূল্যবোধ যে চিন্তা-ভাবনা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও সংকল্প মানুষের সামগ্রিক আচার-ব্যবহার এবং কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে, তাকেই আমরা সাধারণত মূল্যবোধ বলে থাকি। সামাজিক মূল্যবোধ হলো সমাজের ভিত্তি। সমাজ জীবনে মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত আচরণ এবং কর্মকাণ্ড যেসব ইসলামি নীতিমালার আলোকে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাদের সমষ্টিই সামাজিক মূল্যবোধ। জীবনে কোনো প্রকার অন্যায়-অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতন থাকবে না, মানুষ স্বার্থপরতা-সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত থাকবে—এটি ইসলামের শিক্ষা। যেকোনো সমাজের রীতিনীতি, মনোভাব এবং সমাজের অন্যান্য অনুমোদিত ব্যবহারের সমন্বয়ে মানুষের মধ্যে স্নেহ, মায়া-মমতা, সততা, সম্প্রীতি প্রভৃতি সৃষ্টি হয়। এমন হলে সেখানে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ বিদ্যমান আছে বলে মনে হয়। নৈতিক আদর্শসংবলিত সমাজে কোনো অনাচার থাকবে না। ঘুষ, দুর্নীতি, বঞ্চনা, শোষণ, স্বার্থপরতা এসব কুপ্রবৃত্তি থেকে সমাজ মুক্ত থাকলেই তাতে নৈতিকতার আদর্শ প্রতিফলিত হয়। সব ধরনের দুর্নীতি থেকে মুক্ত জীবনই আদর্শ জীবন। নীতি থেকে বিচ্যুত জীবন কখনোই আদর্শরূপে গণ্য হতে পারে না। নবী করিম (সা.) মানবজাতিকে অন্যায় প্রতিরোধের শিক্ষা দিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কাউকে অন্যায় কাজ করতে দেখে তাহলে সে যেন তার শক্তি দ্বারা তা প্রতিহত করে, যদি সে তাতে অক্ষম হয়, তবে মুখ দ্বারা নিষেধ করবে, যদি সে তাতেও অপারগ হয় তবে সে অন্তর দ্বারা ঘৃণা পোষণ করবে।’ (মুসলিম)


আমাদের প্রত্যহিক জীবনে সামাজিক মূল্যবোধের অবস্থান

বর্তমান সমাজে নানা রকম দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটায় নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটছে। জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে দুর্নীতির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। কোনো প্রকার অন্যায়ই যেন অপরাধ বলে বিবেচিত হয় না। নীতিভ্রষ্ট মানুষ নিজেকে অপরাধী বা হীন বলে গণ্য করে না। দুর্নীতির মাধ্যমে বিত্তশালী হয়েও সংকোচবোধ করে না বরং অর্থের অহংবোধে গৌরবান্বিত হয়। সমাজে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন ও আত্মসাতের প্রতিযোগিতা চলছে। সীমাহীন দুর্নীতি সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে সমাজ জীবনকে কলুষিত করে ফেলছে। অথচ পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের ধন-সম্পদ গ্রাস করো না।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত-২৯)

 

নৈতিকতার অভাব দূর করতে হবে

বর্তমান সমাজে মানুষ দারুণভাবে নৈতিকতার অভাব অনুভব করছে। নৈতিক মূল্যবোধ আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাস, বোমাবাজি খুন-খারাবি, অপরাধ, দুর্নীতি, সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড, সুদ, ঘুষ, কালোবাজারি, মুনাফাখোরি, লোভ, লালসা, নারী নির্যাতন, অধিকার আদায়ের নামে নারী জাতিকে ভোগ্যপণ্যের মতো ব্যবহার প্রভৃতি অনৈতিক কার্যাবলি আজকের সমাজকে সম্পূর্ণরূপে কলুষিত করে ফেলেছে। এমতাবস্থায় ইসলামে যে আদর্শ নৈতিকতা রয়েছে তা গ্রহণ করলে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন সুন্দর ও মধুময় হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে। সামাজিক ঐক্য ও নিরাপত্তা বিধানে এবং একটি সংঘাতমুক্ত গঠনমূলক আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে মাহে রমজান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। রমজান মাসে কঠোর সিয়াম সাধনার মাধ্যমে রোজাদার ব্যক্তিরা অপরের বদনাম ও কুটনামি থেকে বিরত থাকেন। তারা সকল প্রকার ঝগড়া-বিবাদ, ফিতনা-ফ্যাসাদ, অযথা বাগিবতণ্ডা ও যাবতীয় খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকেন। তাদের মুখ থেকে কোনো প্রকার অশ্লীল কথা বের হয় না। যদি কোনো রোজাদার লোককে কেউ গালিগালাজ ও ঝগড়া-বিবাদে প্ররোচিত করতে চায়, তখন সেই রোজাদার যদি উত্তেজিত না হয়ে ঝগড়া-বিবাদ ও গালিগালাজ থেকে দূরে সরে যান, তাহলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয় না এবং একটি আদর্শ নৈতিকতাপূর্ণ সহনশীল সমাজ গড়ে ওঠে। নবী করিম (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ কোনো দিন রোজা রাখে তখন তার মুখ থেকে যেন কোনো রকম খারাপ কথা ও শোরগোল বের না হয়। যদি কেউ তাকে গালিগালাজ করে বা ঝগড়া-বিবাদে প্ররোচিত করতে চায় তখন সে যেন বলে, ‘আমি রোজাদার ব্যক্তি।’ (বুখারি)


আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা

সামাজিক মূল্যবোধ মানুষের প্রতি সাহায্য ও সহযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি করে। ফলে সমাজের মধ্যে মানববন্ধন গভীর হয়, মানুষের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপিত হয়। দেশের জন্য ভালোবাসা জন্মে। সামাজিক মূল্যবোধ মানুষের প্রতি সদাচরণ করতে শেখায়, জীবনে শৃঙ্খলা আনে এবং মানুষকে পরিপূর্ণ হতে সাহায্য করে। মানুষের প্রতি মানুষের সহানুভূতির অভাব, কর্তব্যে আন্তরিকতার বদলে দায়সারাভাব, স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যাপক তত্পরতা, জনকল্যাণের প্রতি অনীহা—এসব মূল্যবোধহীনতা মানুষের জীবনকে অশান্তিময় করে তোলে। সুশৃঙ্খল পরিবেশ সামাজিক মূল্যবোধ বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের অভাবে সমাজে বিশৃঙ্খলা বা অসংগতি বৃদ্ধি পায়। পরমতসহিষ্ণুতা ও সহনশীলতার অভাবে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ প্রভৃতি অনাচারের ফলে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চরিত্রের অন্যতম ভূষণ ছিল ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা। রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘সহনশীলতা অপেক্ষা অধিক উত্তম ও অত্যধিক কল্যাণকর বস্তু আর কিছুই কাউকে দান করা হয়নি।’ (বুখারি)


সহনশীলতা সৃষ্টি

রমজান মাসে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের কঠোর ত্যাগ, উদারতা, সততা, ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন। এ মাসটি ধৈর্য অবলম্বনের মাস। ধৈর্যধারণের বিনিময়ে নির্ধারিত রয়েছে অতুলনীয় শান্তির আবাস বেহেশত। তাই এ মাসটির পরিচয় তুলে ধরে ধৈর্য ও সবরের গুরুত্ব প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এটা ধৈর্যের মাস, আর সবরের বিনিময় হচ্ছে জান্নাত।’ (মিশকাত) মাহে রমজানে কঠোরভাবে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে ধৈর্য ও সহনশীলতার যে মানবিক গুণটি অর্জিত হয়, তা শুধু ব্যক্তি পর্যায়ের গুণই নয় বরং এ মহৎ গুণটি কারও মধ্যে সৃষ্টি হলে ঈমানদারের সমষ্টিগত জীবনে অপরের জন্য তা উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে, মানুষকে কঠিন ও দুর্গম পথ পরিক্রমায় চলতে শক্তি জোগায়। রোজা পালনের মাধ্যমে অর্জিত ধৈর্য ও সহনশীলতা ঈমান ও তার ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সাধনায় প্রচুর নিয়ামক শক্তি সঞ্চার করে। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে অর্জিত সহনশীলতা তাই শুধু ব্যক্তিগত কল্যাণই বয়ে আনে না বরং মুসলমান সমাজের জন্য একটি দলগত কল্যাণ বয়ে আনে। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘অবশ্যই ধৈর্যশীলদের তাদের (ধৈর্যের) প্রতিদান পরিপূর্ণভাবে প্রদান করা হবে।’ (সূরা আল-জুমার, আয়াত-১০)


সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি বন্ধ

নবী করিম (সা.) নিজেকে ইসলামি নীতিবোধ অনুযায়ী পরিচালনা করেছেন এবং সাহাবীগণ সে অনুযায়ী নিজেদের চরিত্রকে গঠন করতে উপদেশ দিয়েছেন। ইসলামি রীতিনীতি ও নৈতিকতাবোধ জীবনে বাস্তবায়ন করলে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল খুশি হন এবং ইহকাল ও পরকালে চরম সুখ ও পরম শান্তি লাভ করা যায়। দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণের জন্য জাতীয় জীবন থেকে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। সমাজের সর্বস্তর থেকে সর্বপ্রকার দুর্নীতির অবসান ঘটাতে হবে। দুর্নীতিবাজদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষকে জান-মাল ও জীবিকার পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে হবে। সামাজিক মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন সুদক্ষ প্রশাসন গড়ে তুলতে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে এবং জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম-দেশাত্মবোধ জাগ্রত করতে হবে। সুতরাং আজকের সমাজও যদি ইসলামের সর্বজনীনতাকে মেনে নিয়ে ইসলামি বিধি-বিধান ও অনুশাসনকে রোজাদারদের জীবন ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে, তবেই সমাজ থেকে যাবতীয় অনৈতিকতা দূর হবে।


সামষ্টিক গ্রহনযোগ্য আচরণ

শিক্ষার গ্রহনযোগ্য সংজ্ঞা আর পরিচিতি যাই বলি, সেটা হলো- ‘আচরণের কাংখিত এবং ইতিবাচক পরিবর্তন’। অর্থাৎ যে মানুষটি শিক্ষাগ্রহন করবে তার আচরণটি হবে কাংখিত এবং ইতিবাচক। ব্যক্তির আচরণ আগে যাই থাকুক শিক্ষা অর্জন বা গ্রহনের মাধ্যমে তার আচরণের অনিবার্যভাবে পরিবর্তন ঘটবে। এ পরিবর্তন তার সমাজ পরিবেশ এবং প্রতিবেশ দ্বারা স্বীকৃত।শিক্ষার কথা বললে অবশ্যম্ভাবিভাবে মূল্যবোধটি আমাদের সামনে ধরা দেয়। মূল্যবোধ সেটিই যাকে আমরা মূল্য দেই কিংবা সমাজ যে বিষয়গুলোর উপর মূল্য আরোপ করে। এ মূল্যটা একধরনের মান বা স্ট্যান্ডার্ড। যেটা নির্ধারণ হয় সমাজের নির্ধারিত নর্মস তথা সামষ্টিক গ্রহনযোগ্য আচরণ এবং ইথিকস তথা নৈতিকতার দ্বারা। সমাজের নর্মস এর ভিন্নতায় মূল্যবোধের বিভিন্নতা দেখা যায়। যেমন হতে পারে একটা বিষয় আমাদের দেশে নর্মস কিন্তু আমেরিকায় নয়।সামাজিক নর্মস বা ইথিকস ভঙ্গ হলে বা এর বাইরে কাজ করলে আমরা তাকে দেখি মূল্যবোধের অবক্ষয় হিসেবে। এ মূল্যবোধের অবক্ষয় মানে সামাজিক অবক্ষয়। সামাজিক অবক্ষয় আর শিক্ষা এবং মূল্যবোধ পরস্পর বিরোধী। যারা শিক্ষা অর্জন বা গ্রহন করছে তাদের মূল্যবোধের অবক্ষয় বা তাদেও দ্বারা সামাজিক অবক্ষয়মূলক কাজ সংগঠিত হওয়া অসম্ভব।শিক্ষাকে আমরা যদি একটা ফলযুক্ত গাছের সাথে তুলনা করি বিষয়টা সহজেই বুঝে আসবে। যে গাছে ফল রয়েছে সে গাছটি ফলের ভারে সবসময় নিচু থাকে। যে গাছে যত ফল সে গাছ তত নিচু। সে ফলের দম্ভ প্রকাশ করতে কখনেই মাথা উঠায় না। একজন শিক্ষিত মানুষ যত যত বেশি জ্ঞানী তার ব্যবহার তত মার্জিত, মানুষ হিসেবে তিনি তত বিনয়ী। সামাজিক আচরণ আর শৃংখলার প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল। গাছের ফলটি যেমন অন্যের জন্য ঠিক সে ব্যক্তিটিও হয়ে যান সমাজের জন্য। তার দ্বারা সামাজিক মূল্যবোধ বিরোধী কাজ হওয়া তো দূরে থাক বরং তিনি এ মূল্যবোধ রক্ষায় বেশি সচেষ্ট থাকেন।আমাদের সমাজের বাস্তব অবস্থাটা সম্পূর্ণ বিপরীত।


 

সামাজিক অবক্ষয়ের কিছু চিত্র

সময়ে দেশব্যাপি সামাজিক অবক্ষয়ের যে মিছিল দেখা যাচ্ছে এটা তারই প্রমাণ। নারীর প্রতি সহিংসতা, উত্যক্তকরণ, ধর্ষণ, নির্যাতন, আত্যহত্যা করতে বাধ্যকরণ ইত্যাদি আগের চেয়ে এতবেশি বেড়ে গেছে যা বলাবাহুল্য। গণমাধ্যমের কল্যানে প্রত্যেকদিনই এসব দেখছি। অনেকে এসব ঘটনার বাড়তিকে আইয়ামে জাহেলিয়াতকে ছাড়িয়ে যাওয়ার বিষয় হিসেবে দেখছেন। আমাদের জাতীয় জীবনের দূর্ভোগ এসব সামাজিক অবক্ষয়ের কারণেই বেড়ে গেছে। শুধু নারী নির্যাতন বা নারীঘটিত বিষয়ই নয়- এর বাইরেও দূর্নীতি, ঘূষ, প্রতারণাসহ নানা ধরণের সামাজিক অবক্ষয়মূলক কাজ স্পষ্ট। বর্তমানে বিদ্যুত, গ্যাস, পানির আকাল চলছে। আমাদের চাহিদার তুলনায় এ সম্পদগুলো কমই। ফলে জনগণ অতিষ্ঠ। এরপরও এগুলোর চুরি আর দূর্নীতির সংবাদ আমাদের জন্য কতটা লজ্জাকর। দেখা গেছে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারীর বেতন ১০-১৫ হাজার টাকা হলেও অনেকেরই ঢাকায় রয়েছে নিজস্ব বাড়ি গাড়ি। আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার ঘটনা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার প্রতি কতটা বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে উঠছে ছাত্রী নির্যাতনের অভিযোগ। কয়েকজন শিক্ষক আর কয়েকটি ঘটনায আমাদের পুরো শিক্ষক সমাজটাই কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ।শিক্ষকদের যখন এ অবস্থা শিক্ষার্থীর আবস্থা কী? বর্তমানে ছাত্র সমাজেরও মূল্যবোধের ভয়াবহ রকমের অবক্ষয় ঘটেছে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্যানুযায়ী গত দশ মাসে ৬০০ জন নারী ভয়াবহ সহিংসতার শিকার।নারীর প্রতি এসব সহিংসতা যেমন বাড়ছে সাথে সাথে আইন শৃংখলারও অবনতি ঘটছে। ২০ এপ্রিল রাজধানীতে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়েছেন পুলিশের এস আই গৌতম। এর আগেও ঘটেছে অনেক হত্যাকান্ড। বর্তমান এ সামাজিক অবক্ষয়ের স্বরূপ অন্বেষণে সম্প্রতি রাজধানীতে গোলটেবিল বৈঠক করেছে একটি সংগঠন। অনেকে বলেছেন নেশা জাতীয় দ্রব্য তথা মদ, গাঁজা, ফেন্সিডিল ইত্যাদিও অবাধ ব্যবহার। ছেলে মেয়ের অবাধ মেলামেশা কিংবা মেয়েদের অশালীন পোশাককেও দায়ী করেছেন অনেকে। অনেকে আবার ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে , ধর্মকে বাস্তব জীবনে পালন না করার বিষয়টিও বলছেন।


ধর্মে সামাজিক মূল্যবোধ


প্রত্যেক ধর্মেই অনৈতিক, সামাজিক অবক্ষয়মূলক কাজ নিষিদ্ধ। এসব ঠিকই আছে, তবে আমাদের সমাজকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে অবশ্যই জোর দিতে হবে শিক্ষার উপ্র। যে বিষয়টি প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের শিক্ষা হবে জানা এবং মানার জন্য। পরীক্ষায় পাশ কিংবা চাকরির চিন্তা থাকবেই কিন্তু সেটাই একমাত্র লক্ষ্য হবে না। একজন মনীষীকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো- শিক্ষিত কারা, উত্তরটা ছিলো যে জানে এবং সেটা বাস্তব জীবনে পালন করে। সুতরাং জানার নাম শিক্ষা নয়, মানার নাম শিক্ষা।এক্ষেত্রে নৈতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ আবশ্যক। এবারের শিক্ষানীতিও সে বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। ধর্ম এবং নৈতিক শিক্ষা নামে শিক্ষানীতিতে উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে- ‘শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশের মূল চারটি ধর্ম সম্পর্কে পরিচিতি, আচরণগত উৎকর্ষ সাধন এবং জীবন ও সমাজে নৈতিক মানসিকতা সৃষ্টি একং চরিত্র গঠন’।নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আমাদের রাষ্ট্রীয় আইন আছে। কঠোর আইন। গত বছর প্রণীত এ আইনে বলা হয়েছে, কোন নারীর প্রতি একনাগারে তাকিয়ে থাকাও নারী নির্যাতনের অন্তর্ভূক্ত আর ইভটিজিং তো বটেই। এসব কঠোর আইন থাকা স্বত্ত্বেও কিন্তু বন্ধ হয়নি নারী নির্যাতন। অর্থাৎ আইন করে নারী নির্যাতন বন্ধ কারা সম্ভব নয়। স্কুলের সামনে সাদা পুলিশ মোতায়েন করেও নয়। এটি বন্ধে প্রয়োজন মানুষের মাঝে নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা। সেজন্যই শিক্ষার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নারীর ক্ষমতায়নের দিক দিয়ে এক অবিস্মরণীয় কাল চললেও নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হয়নি একটুও।মূল্যবোধ শিক্ষাই আমাদের এ সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারবে। শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই এ মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। শিক্ষার প্রতিটা স্তরে মূল্যবোধ তা নৈতিক শিক্ষাকে আবশ্যক করে একে কার্যকরভাবে শ্রেণীতে উপস্থাপন করা দরকার। এ মূল্যবোধ শিক্ষা নিশ্চয় শিক্ষার্থীকে একদিকে যেমন দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগ্রত করবে অন্যদিকে সামাজিক অবক্ষয়মূলক কাজ হতে বিরত রাখবে।


ক্ষুধা দারিদ্র দূর করা


সমাজে তথা দেশে ছড়িয়ে যচ্ছে মাদক। রাঘববোয়ালেরা ধুরন্ধর। যারা মাদকপাচারের সময় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের সদস্যদের হাতে ধরা পড়ছে তাদের সিংহভাগই দারিদ্র্য সীমারেখার বহু নিচে অবস্থান করা পরিবারের নারী বা পুরুষ। তারা মাদকচক্রের রাঘববোয়ালদের হদিস দিতে পারছে না। দিন দিন যে বিষয়টি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে তা হলো- দরিদ্রতার কষাঘাতে বিপথগামী নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্যরা গ্রেফতার, জেল-জরিমানাকেও তোয়াক্কা করছে না। তা না হলে একই নারী মাদকপাচার করতে গিয়ে একবার ধরা পড়ার পরও মাদকপাচার থেকে মুখ ফেরাচ্ছে না কেনো? কেনো একজন নারী মাদকপাচার সংক্রান্ত বহু মামলায় জড়িয়ে পড়ছে?  চোরাচালান, মাদক ও সন্ত্রাস যেনো অদৃশ্য একই সুতোয় গাঁথা। অল্পতে অধিক লাভের আশায় অনেকেই চোরাচালানের পথ ধরে। বাজার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকা দেশের সীমান্তবাসীদের মধ্যে অর্থলোভীদের কাজে লাগিয়ে চোরাচালানচক্রের রাঘববোয়ালরা দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডে আঘাত করে কালো টাকার পাহাড় গড়ে। এদেরই একটি অংশ মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিক দেয়ার প্রলোভনের জাল ফেলে পাচার করাচ্ছে মাদক। দারিদ্র্য সীমারেখার বহু নিচে অবস্থান করা পরিবারের নারীদের অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে এ জালে। সন্ত্রাস? সন্ত্রাস মূলত ওই সমাজেই বেশি, যে সমাজ আর্থসামাজিক উন্নয়নে পিছিয়ে পড়েছে। চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা রক্তাক্ত জনপদ হিসেবে শুধু কলঙ্কিতই নয়, মাদক চোরাচালানীদের অন্যতম রুট হিসেবেও লজ্জার তিলকপ্রাপ্ত বললে খুব একটা ভুল হয় না। কারণ কি শুধুই পিছিয়ে পড়া? পাশেই প্রতিবেশী দেশের বিশাল সীমান্ত। সীমান্তের ওপারে অসংখ্য মাদককারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। একই সাথে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। বলার অবকাশ রাখে না যে, পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ ক্ষুধার কাছে বড্ড অসহায়। সে কারণেই দরকার দারিদ্র্য বিমোচনে সম্মিলিত প্রচেষ্টা। নানামুখি উদ্যোগ।


নারীর ক্ষমতায়ন


নারীর সব ক্ষমতায়ন মিলে ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ যে প্রত্যয়টা, তার উদ্দেশ্য ছিল দেশের সার্বিক উন্নয়ন। কেননা নারী-পুরুষের সমান অংশীদারিত্ব ছাড়া একটি দেশ কখনোই সামনে এগুতে পারে না। কিন্তু নারীর এই ক্ষমতায়নকে যদি আমরা ডিভোর্সের পেছনের কারণ হিসেবে মনে করি, যার ফলে সমাজের যে ক্ষুদ্র সংগঠন পরিবার, তা যদি ভেঙে যায় তবে সে সমাজের বা দেশের সার্বিক কাঠামোও ভঙ্গুর হতে বাধ্য। উন্নত বিশ্বও আজ সে কারণে পরিবারব্যবস্থার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। কেননা আমরা জানি একটি সুন্দর পারিবারিকব্যবস্থার মধ্যে বেড়ে ওঠা শিশু আর একটি ভঙ্গুর পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুর মধ্যে ব্যক্তিত্বের ধরন এক হয় না কখনো। একটা সুন্দর পারিবারিক আবহই পারে একটি শিশুর কাছ থেকে তার কাঙ্ক্ষিত আচরণ, তার মেধা, মননশীলতাকে বের করে আনতে, যা যে কোনো দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর। তাই ডিভোর্সের মাধ্যমে শিশুদের বিকাশকে ধ্বংস করা মানেই গোটা জাতির ধ্বংস ডেকে আনা। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্য নিশ্চয় তা ছিল না, তাই যারা নারীর ক্ষমতায়নকে ডিভোর্সের কারণ বলে মনে করেন, তাদেরসহ সকল ক্ষমতায়িত নারী-পুরুষকে বলবো_ ক্ষমতা মানে ব্যক্তিগত প্রাপ্তির জন্য নিয়ন্ত্রণ বা শোষণ নয়। এটি ধ্বংসমূলক ও নিপীড়নমূলক মূল্যবোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত, যা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য ক্ষতিকর। এটি তাদেরকে প্রতিযোগিতা ও দুনর্ীতি করতেই উৎসাহী করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা মানে অংশগ্রহণ আদান-প্রদান, সকল মানব সন্তানের সম্ভাবনার বিকাশ ও উন্নয়ন। তাই প্রতিটি নারী-পুরুষকে হতে হবে সহিষ্ণু, সহমমর্ী, সমব্যথী, কর্তব্যপরায়ণ।


সমাজকে মরনের দিকে ঠেলে দেয়া


ফরমালীনের ভয়াবহ ব্যবহার সর্বত্র হয়েছে, মাছ কিনতে গিয়ে শিক্ষিত বুড়োলোক সবগুলো মাছ দেখছেন। মাছ বিশেষজ্ঞ বুড়ো কোনমতেই মাছ পছন্দ করতে পারছেন না, একেকটির একেক বদনামী। মেয়ের জামাই আসবেন মাছ নিতেই হবে। একটা মাছ পছন্দ করলেন, দর দাম ঠিক হল, হঠাৎ তিনি প্রশ্ন করলেন আপনার দোকানে মাছি নাই কেন? দোকানী তাজ্জব হয়ে বললেন মাছি দিয়ে কি হবে? মাছি নাই সুখের কথা আলহামদু লিল্লাহ পড়েন। বুড়ো বলেন ঠিক, মাছি নাই দেখেই আলহামদুল্লাহ পড়ছি, যে মাছে মাছির আকর্ষন নাই, সে মাছ আমিও কিনবনা। দোকানী ঝগড়া বাধালেন, প্রশ্ন ছুড়লেন, তো এখন থেকে মাছ বিক্রি করতে মাছিও কি রাখতে হবে? নাকি মাছিও ভাড়া করে আনতে হবে? বুড়ো বললেন মাছিকে আল্লাহ অপ্রয়োজনে সৃষ্টি করেননি। তার ঘ্রাণ শক্তি, খাদ্য বাছাই করার ক্ষমতা, উপযোগী খাদ্য নির্বাচনে মানুষের চাইতে হাজার গুন বেশী দক্ষতা রাখে। দেখ তোমার পাশের ব্যক্তির লটিয়া ও ছুরি মাছে, মাছি ভনভন করছে। রুই-কাতলা-মৃগেল কোনটার আশে পাশেই মাছি নাই, কারন মাছি বুঝে গেছে সেখানে মরনের দারু লুকিয়ে আছে! আমি ছাত্র জীবনে এক মৃত চড়ুই পাখির শরীরে ফরমালীন ঢুকিয়ে খাটের নীচে রাখি। হোষ্টেল জীবনের বছর খানেক সেখানেই পড়ে ছিল, পরে জিনিষ পত্রের সাথে তা বাড়িতে চলে য়ায়। মাটির ঘরে পুরানো সিন্দুকের চাকার পাশে তাকে লুকিয়ে রাখি। ৮ বছর পর, ঘর পরিবর্তনের সময় তাকে আবার আবিষ্কার করি। আমি তাজ্জবের সাথে দেখি বিগত ৯ বছর সেটা মাটিতে ছিল, যেখানে পিঁপড়া ছিল, উঁইপোকা ছিল, মাটি স্যাঁতসেতে ছিল, সাথে কুনোব্যঙের আস্তানা ছিল, নেড়ী ইঁদুরের উৎপাত ছিল, তেলাপোকার আনাঘোনা ছিল; কেউ তাকে ছুয়েঁ দেখেনি। অবিকল সেধরনের পেয়েছি যা ৯ বছর আগে করেছিলাম। আজ এই বিষাক্ত জিনিষ মানুষকে অহরহ খাওয়ানো হচ্ছে।


শঠটা


শঠতার অপরাধে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন একটি জাতিকেই ধব্বংস করে দিয়েছেন। ওজনে কম দিত এমন একটি জাতিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। খাদ্যে ফরমালীন মিশানোর শঠতায় ইসলামে মৃত্যুদন্ড হবে। কুত্তার মূত্র মিশ্রিত মিহি দানা, ইদুর গলিত আইসক্রিমের শঠতায় যাবতজীবন কারাভোগ কপালে জোঠবে। মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ধর্মে পরিষ্কার থাকার প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ধর্ম পালনকারী ব্যক্তিরাই পরিষ্কারের প্রতি যথেষ্ট সচেতন। ইসলাম ধর্মে পরিষ্কারের জন্য রিতীমত বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। আল্লাহর অস্থিত্বের উপর বিশ্বাসকে ঈমান বলে। ঈমানের ৭২টি শাখার মধ্যে দুটোর একটি হল পবিত্রতা অন্যটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। অর্থাৎ অপবিত্র ও অপরিষ্কারে ঈমান নষ্ট হয় এবং তা আল্লাহকে অস্বীকার করার সমতূল্য। বাংলাদেশে ভেজালের বিরুদ্ধে জনমত সোচ্চার, কঠিন আঈন আছে, সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তার অভাবে তা চোরাবালিতে আছড়ে পড়ছে। নৈতিক শিক্ষার অভাবে ভেজালের কাজে ক্রেতা-বিক্রেতা, ধনী-দরীদ্র সবাই একই কাতারে এসে গেছে।

ইসলামে সামাজিক মূল্যাবোধ


প্রতিদিনের মত, একদা ওমর (রাঃ) শেষ রাত্রে একটি মরু কুটিরে বাতির আলো দেখতে পেলেন। বিপদগ্রস্থ পরিবার মনে করে, তিনি আলোর উৎসের সন্ধানে গেলে পর, কুঠির থেকে এক মায়ের ডাক শুনতে পেলেন। মা বলছেন, আমেনা উঠ, দুধে পানি মিশাতে হবে সকাল হলে তা সম্ভব হবেনা। মেয়ে আমেনা প্রত্যুত্তরে বললেন, মা খলীফা ওমর নিষেধ করেছেন দুধে পানি না দিতে। মা ধমকের সূরে বললেন, এখানে কি খলীফা ওমর দাঁড়িয়ে আছেন যে, তোমার কাজ দেখবেন? মেয়ে শুধালেন, মা ওমর এখানে না থাক, আল্লাহতো সব অবলোকন করছেন, এতে মা লজ্জা পেলেন।  ওমর কালবিলম্ব না করে সকাল হতেই তাঁর ছেলেদের ডেকে পাঠালেন। পুত্রদের উদ্দেশ্যে ওমর বললেন, হে পুত্রগন! আমি তোমাদেরকে একটি মেয়ের সন্ধান দিব, সে একটি জীবন্ত রত্নের মত। বেদুইন বস্তির, ঐ ঘরের বাসিন্দা সে, আমি তাকে দেখেনি, গলা শুনেছি মাত্র। তোমাদের মধ্য থেকে কেউ যদি তাকে, নিজের যোগ্যতায় বউ করে আন, তাহলে স্বামী হিসেবে সে উপকৃত ও ভাগ্যবান হবে। বলা মাত্রই এক সন্তান দাঁড়িয়ে গেল, তিনি বললেন পিতাজি, আপনার পক্ষ থেকে আত্বীয়তা করার প্রস্থাব পেলে আমি এক্ষুনি সে মেয়ের পিতার কাছে বিয়ের পয়গাম দিতে চাই। মধ্য এশিয়া থেকে মিশর, ইয়েমেন থেকে ইতালী পর্যন্ত, আধা দুনিয়ার মানুষের প্রতিনিধি ওমর (রাঃ) ছেলের আগ্রহে বেদুইন কণ্যাকে পুত্রবধু বানাতে সানন্দে রাজী হলেন। বিয়ের পয়গাম পাঠালেন এবং বিয়ের পরে মনখুলো দোয়া করেছিলেন, “হে পরোয়ার দিগার তুমি এই নারীর বংশে ইতিহাস বিখ্যাত সন্তান দিয়ে কোল ভরে দিও”। ইতিহাসের সাক্ষ্যি, পঞ্চম খলিফা খ্যত ওমর ইবনুল আবদুল আজীজ (রহঃ) তাঁদেরই নাতি ছিলেন, দাদী ছিলেন যার শিক্ষক। যে ওমরের ঘরে রাজকুমারী আসার কথা, অথছ সেখানে এসেছেন এমন একজন গরীব বেদুইন কণ্যা, যার একটি গুণ ছিল খাদ্যে ভেজাল না দেওয়া, মানুষকে না ঠকানো। এই একটিমাত্র গুণ একজন মানুষকে যদি পৃথিবীতে শ্রেষ্টত্বের আসনে সমাসীন করে। তাহলে এই জাতীয় হাজারো খারাপ গুনে গুণান্বিত একটি জাতি কিভাবে বেঁচে থাকে, সেটাই আশ্চর্য্যের বিষয়? অথছ আমাদের চাইতে শঠতায় অনেক কম উদাহরন সম্পর্ন্ন জাতিকে আল্লাহ চিরতরে নিশ্চিহ্ন করেছেন, পৃথিবীর মানচিত্র ও ইতিহাস থেকে। তাই সবাইকে সচেতন হওয়া উচিত, নূন্যতম মূল্যবোধ জাগ্রত করে প্রশাসনকে সহযোগীতা করা, নিজেদের মধ্যে সংগঠিত ভাবে প্রচার-প্রচারণা চালানো, জনগনকে উৎসাহ প্রদান, ব্যবসায়ীদের এ অনৈতিক কাজে নিরুৎসাহ প্রদান করা ইত্যাদি। কেয়ামতের দিন একদিকে থাকবে পাপের পাহাড়, অন্যদিকে থাকবে কাগজতুল্য পূর্ণ্য। দুঃচিন্তা গ্রস্থ বিচার প্রার্থী দেখবে, পাপের পাহাড়ের বিপরীতে, পাল্লায় কাগজ দেওয়া মাত্র, পাহাড় শূণ্যে উঠে গেছে। তাজ্জব হয়ে সে প্রশ্ন করবে এগুলো কোন কাজের প্রতিদান? বলা হবে মানুষের জন্য জনকল্যাণ মূলক কাজে যে অবদান, ব্যবহার ও আচরণ করতে এগুলো তার প্রতিদান। সে আফসোস করবে এই সামান্য কাজের এত মূল্য! ইস্‌! পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে যদি সারাজীবন এই কাজ করতাম, তবে কতইনা ভাল হত।

 

স্বাধীন বাংলাদেশ


মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও স্বার্থের এক কঠিন সংঘাত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ-এর অভ্যুদয় ঘটে। সেই সংঘাত এর একটি পর্যায়ের পরিণতি ঘটে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে। ভারতীয় কংগ্রেসপন্থী আওয়ামী লীগের দাবীমত দৃশ্যতঃ এটা প্রতিভাত হয় যে, ঐ পর্যায়ে পাকিস্তানী মূল্যবোধকে বিপর্যস্ত করে জয়ী হয় বাঙালি সংস্কৃতি। তাদের জয়ী হবার দাবীর কারণ ১৯৭১ সনের যুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা একশ্রেণীর বাঙালি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেই পরাজয়কে পূর্ব বাংলা/পূর্ব পাকিস্তান/বাংলাদেশের মাটিতে মুসলিম মূল্যবোধের পরাজয় হিসেবে আখ্যায়িত করে। তারা এও বলে যে, সীমান্তের বাইরে থেকে মুসলমানদের দ্বারা আনীত মূল্যবোধ ছিল বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নেয়া মূল্যবোধের পরিপন্থী। এরই ফলে শেখ মজিবের নেতৃত্বে নতুন বাঙালি শাসকরা পূর্ব থেকে বিদ্যমান মুসলিম পরিচয় জ্ঞাপক সকল প্রতীক, নাম ও পদচিহ্ন পরিবর্তন করে ফেলে। এমনকি কোরানের অনেক বাণী যেমন ‘রাব্বী যিদনি ইলমা’ ‘ইক্রা বিস্মি রাব্বিকা আল লাজী খালাক’ যা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মনোগ্রাম-এ অংকিত ছিল, তা পরিবর্তন করে সেখানে এমন কিছু বাংলা বাক্য বা শব্দ প্রতিস্থাপন করা হয় যেগুলোর মধ্যে ইসলামী মূল্যবোধে উজ্জীবনের কোন দিক-নির্দেশনা বা অনুপ্রেরণা নেই। এমনকি নতুন বাঙালি শাসকরা মুসলমান পরিচয় জ্ঞাপক সকল কিছুকে বর্হিদেশীয় এবং সংশোধনযোগ্য বলে চিহ্নিত করে এবং সকল সরকারী প্রচার মাধ্যমে ইসলামী প্রতীক ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায়। অনৈসলামিকীকরণের এই সব কর্মসূচী মূল্যায়ন করলে বোধশক্তি সম্পন্ন যে কারোরই নিকট এটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে ওটার লক্ষ্য ছিল সংশ্লিষ্টদের বিবেচনায় বাঙালি প্রথা ও মূল্যবোধকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার ক্ষেত্র সৃষ্টি করা। এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, বৈদিক ও হিন্দু পুরান এর ঢামাঢোলে তাদের সকল মূল্যবোধ নিমজ্জিত করার অপপ্রয়াসে হয়তো বাঙালি মুসলমানরা বিস্মৃত হতোনা; কিন্তু যে সব মূল্যবোধের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই, তা তাদের নিকট কোন অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। বস্তুতঃ পৌরনিক পূর্বযুগের অন্ধ সাধু দীর্ঘতমার- এর জারজ সন্তান ‘বঙ্গ’র ব্যক্তিত্ব ও আচারাদির মধ্যেই তারা জাতির উৎসের সন্ধানে ব্যপৃত হয়।

 

সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা ধ্বংস


ব্যর্থতা ও হতাশা সব সমাজেই ব্যক্তির জীবনকে আক্রান্ত করতে পারে। কিন্তু তা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা ও সংগ্রামের বদলে ব্যক্তি যখন নিজের ও অপরের জন্য ধ্বংসাত্মক ক্রিয়াকর্মে আত্মসমর্পণ করে, তখন সেটা কেবল তার নিজের বা পরিবারের জন্য নয়, গোটা সমাজের জন্য হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর। একজন বেকার ও হতাশ তরুণ যখন সন্ত্রাসী বা অপরাধ জগতের সদস্য হয়ে ওঠে, তখন সে কেবল নিজের জীবনের জন্য অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা ডেকে আনে না, সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা ধ্বংসের জন্যও কাজ করতে থাকে। হতাশ তরুণরা যে সকল অপরাধকর্মে সহজেই জড়িয়ে পড়ে, তার মধ্যে মাদকাসক্তি প্রধান। আমরা খেয়াল করি আর না করি, মাদকাসক্তি আমাদের সমাজে ইতোমধ্যে এরকম একটি ভয়ঙ্কর ও ধ্বংসাত্মক ক্রিয়া হয়ে উঠেছে। শহর কি গ্রাম _ সর্বত্রই মাদকের ভয়াল থাবা প্রসারিত হয়েছে। একটি তথ্যসূত্র মতে, বাংলাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা এখন ৫০ লাখেরও বেশি। বেসরকারি জরিপ অনুযায়ী এই সংখ্যা বর্তমানে ৭০ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। মাদকাসক্তদের ৯১% কিশোর ও যুবক। তাদের অধিকাংশেরই বয়স ২১ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। প্রধানত হতাশা ও মানসিক অবসাদের কারণেই দেশের সম্ভাবনাময় ও উজ্জ্বল তরুণ সমাজ মাদকের কাছে আত্মসমর্পণ করে নিজেদের আত্মবিনাশকে ত্বরান্বিত করছে।


সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ


বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় এখন পর্যন্ত পরিবার একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন। পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলিতে রাষ্ট্রীয় আইন ও ব্যক্তির মৌলিক অধিকারগুলি গুরুত্ব পায় বেশি। সে তুলনায় এ দেশে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ দ্বারাই পরিচালিত মানুষ এখন পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ দেশের সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে মাদক প্রবেশের কোনো সুযোগ পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু তারপরও মাদকের এই বিস্তার দেখে অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে, দেশে পারিবারিক বন্ধন যেমন আলগা হচ্ছে, তেমনি সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ও ঘটে চলেছে। কী কী কারণে এবং কোন্ পথে এই ধ্বংসাত্মক প্রবণতাগুলি সমাজজীবনকে গ্রাস করছে, তা নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা ও বিচার-বিশ্লেস্নষণ হওয়া দরকার। তবে মোটা দাগে মাদকাসক্তি বিস্তারের যে কারণগুলিকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে, তার মূল একদিকে বর্তমান বিশ্বায়নের গতি এবং অন্যদিকে দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে নিহিত রয়েছে।

 

 

 

সৌন্দর্য সম্ভোগের মূল্যবোধ

বস্তুজগতের সৌন্দর্যকে উপলব্দি করতে পারা, ব্যক্তিজীবনের একটি আদর্শ বৈশিষ্ট্য। সৌন্দর্য সম্ভোগ হল এক বিশেষ ধরণের অনুভূতিযুক্ত অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা লাভের জন্য একদিকে ব্যক্তির পূর্ব অভিজ্ঞতারও প্রয়োজন আছে। তেমনি অন্যদিকে ব্যক্তির মধ্যে ধণাত্মক অনুভূতি সৃষ্টিরও প্রয়োজন আছে। আবার এই সৌন্দর্য সম্ভোগ একধরণের একক সমঞ্জস্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা। অর্থাৎ, কোন বস্তু, ঘটনা বা পরিস্থিতিকে পূর্ব অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে এককভাবে প্রত্যক্ষ করি এবং তার উপর আমাদের ব্যক্তিগত অনুভূতিকে প্রয়োগ করি, তখনই সৌন্দর্য সম্ভোগ সম্ভব হয়। শিক্ষামূলক অভিজ্ঞতা দ্বারা সৌন্দর্য সম্ভোগ করা যায়।

আমাদের প্রত্যহিক জীবনে সৌন্দর্য সম্ভোগের মূল্যবোধের অবস্থান


স্তুবাদী জীবনদর্শন, ভোগবাদী চিন্তা-চেতনা, স্বার্থবাদী মন-মানসিকতা এবং আত্মসর্বস্ব ধ্যান-ধারণা আজ মানবতাকে অক্টোপাসের ন্যায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। মানব সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, শিরায় শিরায় মহামারীর জীবাণুরূপে অনুপ্রবেশ করেছে।মানুষের আচার-আচরণ, চাল-চলন, বিচার-বিশ্লেষণ, কাজ-কর্ম, কথা-বার্তা, পারস্পরিক সম্পর্ক, সর্বোপরি সবকিছুতেই সে ক্ষুদ্র জীবাণুর প্রলয়ংকরী নৃত্য সতত সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হচ্ছে।ফলশ্রুতিতে ভাল-মন্দ, মান-অপমান, সম্মান-অসম্মান, মর্যাদা-অমর্যাদা, ভদ্রতা-ইতরতা, শ্রেষ্ঠতা-নীচতা, ধনাঢ্যতা-দীনতা, যোগ্যতা-অযোগ্যতা, সফলতা-ব্যর্থতা এবং পূর্ণতা-অপূর্ণতার মূল্যায়নও হচ্ছে বস্তুবাদী তুলাদন্ডের ঝোঁকপ্রবণতার উপর ভিত্তি করে। বাহ্যিক অবয়ব, দৈহিক সৌন্দর্য, সাজ-সজ্জার সৌকর্য, পোশাকের সু্নিপুণ কারুকার্য, বংশীয় কৌলিন্য, গোত্রীয় আভিজাত্য, জন্মভূমির শ্রেষ্ঠত্ব, সম্পদের প্রাচুর্য, শক্তির আধিক্য, ভাষার অলংকারিত্য, পেশার উন্নতি, দেশের সমৃদ্ধি, যাতায়াত মাধ্যমের বিলাসিতা, বাসস্থানের আধুনিকতা, পানাহারের বৈচিত্র্য এসবই হচ্ছে পার্থিব মান-সম্মান, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার বস্তুবাদী সৌন্দর্য বোধক মানদন্ড।


বাহ্যিক সৌন্দর্যের আগ্রহ

আমাদের দেশ থেকে, সমাজ থেকে, রাজনীতি থেকে নীতি ও আদর্শের বিদায় হয়েছে সামরিক শাসনের কাল থেকে। দীর্ঘ পনেরো বছরের সামরিক শাসনের হাত থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি উনিশশো নব্বইয়ের শেষ লগ্নে। তারপর নির্বাচিত রাজনৈতিক দলের শাসনে কেটেছে ষোল বছর। এই ষোল বছরে কি আমরা পেরেছি সামরিক শাসনের সৃষ্ট দুর্বৃত্তায়নের পথ থেকে বেরিয়ে আসতে? হয়তো কোনো দলের দোষ একটু বেশী, কোনো দলের একটু কম, কিন্তু সামগ্রিকভাবেতো আমরা অধঃপতিত হয়েছি। রাজনীতির অধঃপতনের সাথে সাথে নৈতিক পতনও ত্বরান্বিত হয়েছে। দেশের সাধারন মানুষের সামনে ‘নায়ক’ হয়েছে তারেক-মামুন-বাবরদের মত নীতিহীন, দুর্বৃত্তরা। খুনী, লুটেরা শিল্পপতিদের সব অন্যায়কে আমাদের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের একাংশ প্রশ্রয় দিয়েছে অর্থের বিনিময়ে, মাসিক মাসোহারার বিনিময়ে।  দেশের শাসনভার হাতে নিয়ে ক্ষমতাসীনরা দুহাতে লুন্ঠন করেছে রাষ্ট্রের সম্পদ।  দেশের বর্তমান সরকারকে নিয়ে আশার পাশাপাশি আমাদের অনেকের নানামুখী উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। যদিও ভবিষ্যতই এব্যাপারে যথার্থ মূল্যায়ন করবে। তবে তাদের কল্যানে আমরা ‘ দুর্নীতির অথৈ জলের নীচে ডুবে থাকা বিশাল শৈলচূড়ার শীর্ষদেশ’ খানিকটা হলেও দেখতে পেলাম। ভবিষ্যতের কোনো রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এসে এইসব দুর্বৃত্তদের আইনের মারপ্যাচে মুক্তি দেবেন কি না জানি না, তবে ভাবতে কষ্ট হয় এইসব নষ্ট মানুষগুলো কিংবা তাদের তথাকথিত গর্বিত স্বজনেরা আবার বুক ফুলিয়ে প্রকাশ্যে বিচরন করবে। আরো নষ্ট-ভ্রষ্ট হবে এইসব লুটেরার দল, তছনছ করে দেবে আমাদের শুদ্ধতার বাগানগুলো।  আমরা কবে প্রকৃত শিক্ষার আলোয় উজ্জ্বল হবো? আমাদের রাজনীতিবিদরা কবে সততা-দক্ষতা-নৈতিকতায় দীক্ষা নিয়ে আমাদের ভবিষ্যত নির্মানে নেতৃত্ব দেবেন? আমরা কবে আমাদের তরুন প্রজন্মের হাতে ‘ইয়াবা’র পরিবর্তে তুলে দেবো সদ্য প্রকাশিত কবিতার বই?  আমরা কবে প্রকৃত মানুষ বিনির্মানে উৎসাহিত হবো? আমরা কবে বিশ্বাস করবো, মানুষের যা কিছু সম্পদ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী ও ভঙ্গুর হলো বাহ্যিক সৌন্দর্য। মানুষ প্রকৃত সুন্দর হয় তাঁর অন্তর্গত সৌন্দর্যের আলোয়। 


 

নির্ভরশীলতা ও সৌন্দর্য

‘“‌‌‌ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে এথেন্সবাসী করেছেন, বর্বর করেননি, তাঁকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে মুক্তপুরুষ তৈরি করেছেন, স্ত্রীলোক বা ক্রীতদাস করে তৈরি করেন নি।”’ উক্তিটি যেন-তেন কারো নয়; বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক প্লেটো-র। কারো কারো মতে যিনি নারীমুক্তি আন্দোলনের পথপ্রদর্শক এবং বিশ্বাসী। তৎকালীন সমাজব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নাকি ব্যক্তিগত মানসিকতা, মনস্তাত্ত্বিকতা বা দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী প্লেটো উক্তিটি করেছেন তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে। সে বিতর্কে যাবার জায়গা এটা নয়। তবে উক্তিটিতে স্পষ্টভাবেই তিনি নারীকে ক্রীতদাসদের সমতূল্য বিবেচনা করেছেন। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে করা প্লেটোর এ উক্তির বাস্তবতা যে আজও বহাল তবিয়তে রয়েছে তা জানতে আমাদের বেশি দূর যেতে হয় না। এর জন্য পাবলিক বাসগুলোর দিকে তাকানোই যথেষ্ট; যেখানে কিছু আসন সংরক্ষিতকরণের চিহ্নস্বরূপ লেখা থাকে- মহিলা/শিশু/প্রতিবন্ধি। ইঙ্গিতটি স্পষ্ট। নারীকে বিবেচনা করা হচ্ছে শিশু ও প্রতিবন্ধিদের মতো দুর্বল হিসেবে; যাদের বাড়তি সুবিধার প্রয়োজন। বাসওয়ালারা যে অবচেতন মনেই এ কাজটি করেছেন তা ধরে নেয়া যায়। আমাদের শক্তিশালী সামজিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বিলিকৃত মতাদর্শ আমাদের এতটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে শুধু এই অর্ধশিক্ষিত কিংবা নিরক্ষর বাসওয়ালারাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীরাও নারীকে এরকম দুর্বল, অধস্তন, পুরুষের প্রতি নির্ভরশীল, সৌন্দর্য ও যৌনপ্রতীক হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। প্রচলিত গালি, প্রবাদ, সঙ্গীত কিংবা কৌতুকেও এর প্রকাশ ঘটে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় আমাদের প্রচলিত গালিগুলো যাকে উদ্দেশ্য করেই নিক্ষিপ্ত হোক না কেন, গালির মাধ্যমে যাকে আক্রমণ করা হয় সে হলো কোন নারী, মা বা বোন বা স্ত্রী। কোন পুরুষকে অপদস্ত করবার সবচেয়ে কার্যকর পথ হচ্ছে তার মা, বোন, কন্যা বা স্ত্রীর ‘সতীত্ব’ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন বা তাদের কারও সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ইঙ্গিত। এছাড়া প্রতিটি ভাষায় বিশেষ্য-বিশেষণ পদগুলো খেয়াল করলে দেখা যায় তার অধিকাংশই পুরুষবাচক; আকার-ইকারযোগে শব্দের রূপান্তর ঘটিয়ে নারীবাচক শব্দ তৈরি করা হয়েছে। এতেই বোঝা যায় আমাদের সংস্কৃতি-সভ্যতা নির্মাণ ও টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে পুরুষ কতটা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।

 

সৌন্দর্যের ধারণা

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সৌন্দর্যের ধারণা পাল্টেছে, তার সঙ্গে দার্শনিকতার ভিত্তির পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষের ব্যক্তিজীবনের পরিসীমার মধ্যেও এই ধারণা ঘনগণ বদলে যেতে পারে। এসব ব্যাপার আমি বাধ্য হয়েছি ভাবতে। বুঝেছি সৌন্দর্য ব্যাপারটা কিচুই নয়, শুধু একটা প্রতীক। কিন্তু কিসের প্রতীক, আপনি প্রশ্ন করতে পারেন। সত্যের প্রতীক, নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। সুন্দরের মূল্যবোধ, এই ব্যাপারটা প্রতিটি যুগের সমসাময়িক মানুষগুলোর চৈতন্যবোধের স্তর বুঝতে চেষ্টা করায় সাহায্য করেছে। একটা সময় ছিলযখন এই সত্য ভেনাসের মূর্তিতে প্রতিফলিত হয়েছিল। কিংবা বিবিন্ন মূর্তিতে যেখানে নারীর বসুধা রূপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। এব্যাপারে পিকাসোর কাছে থেকে যেভাবে আমরা সৌন্দর্যের উপলদ্ধি করতে শিখেছি তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারন, তিনি, সৌন্দর্য যেমন ঠিক সেইভাবে না এঁকে, সুন্দরকে আরো গৌরবান্বিত করেছেন। সুন্দরের ধ্বংসকারী ভূমিকাটি নিজে থেকে প্রতিপন্ন করে, যেখানে তিনি একাধারে ভর্ৎসনাকারী, আপকারী-। রহস্য হলো সৌন্দর্যের প্রকৃত সত্র, সেই ভাষাকে না যায় পাঠোদ্ধার করা না যায় শব্দ দিয়ে তার ব্যাখ্যা করা কিন্তু যখন কেউ সৌন্দর্যের সামনে এসে দাঁড়ান, তার মুখোমুখি হন, তার বিরোধিতা করেন, তার অস্তিত্বকে অনুভব করেন তখন সেই প্রত্যক্ষকারী হয়ে পড়েন আবেগবিহুল। সুন্দর বস্ত সদা বিস্ময়কর, তা একধরনের জাদু। তা আমাদের এমন এক নম্বর জগতে নিয়ে যায় যেখানে মৃত এসে পৌঁছতে পারে না।

 

উদ্যান স্থাপত্য এর সৌন্দর্য সমীক্ষণ

চীনের উদ্যান স্থাপত্যের ইতিহাস সুপ্রাচীনকালের । বিশ্বের উদ্যান ইতিহাসে এর বেশ সুখ্যাতি রয়েছে। তিন হাজার বছরেও বেশি সময় আগেকার চৌ রাজবংশের আমলে চীনে সর্বাগ্রের রাজপ্রাসাদের উদ্যান দেখা যায়। চীনের নাগরিক উদ্যান খুবই সমৃদ্ধ। বিশ্বের তিনটি বৃহত্ উদ্যান ব্যবস্থায় এটি উজ্জ্বল স্থান দখল করে আছে। পাহাড় আর পানির মাঝে তৈরী চীনের উদ্যানগুলোর শৈলী বৈশিষ্ট্যময়। এ সব উদ্যানের বিন্যাস নমনীয় আর পরিবর্তনশীল । তা ছাড়া এ সব উদ্যানে কৃত্রিম আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের শেল অকল্পনীয় সৌন্দর্য হিসেবে প্রকাশ পায়। এ সব উদ্যান স্থাপত্য সাধারণত পাহাড় আর পানির মধ্যে নির্মিত হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এ সব উদ্যানে পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়। চীনের উদ্যান স্থাপত্যগুলোতে সুমহান রাজকীয় উদ্যান আর ব্যক্তিগত উদ্যান অন্তভুর্ক্ত। এ সব উদ্যানে কৃত্রিম পাহাড় , ফুল, ঘাস , গাছ করিডোর প্রভৃতি ব্যবস্থা সুন্দরভাবে সাজিয়ে চিত্তাকর্ষক পরিবেশের সৃষ্টি করা হয়েছে যার প্রশংসা করে শেষ করা যায় না। চীনের উদ্যানগুলোকে উত্কর্ষের তিনটি পযার্য়ে বিভক্ত করা হয়। এই তিনটি পর্যায় হল প্রশাসন, দেবতা এবং প্রকৃতি। চীনের লু তত্ত্বে যে বাস্তবতা, উচ্চ পর্যায়ের সামাজিক দায়িত্ববোধ , নৈতিক মূল্যবোধ আর রাজনৈতিক চিন্তাধারা উল্লেখ করা হয় তা উদ্যানের নকশায় প্রতিফলিত হয়। এটা সাধারণত রাজকীয় উদ্যানগুলোতে দেখতে পাওয়া যায়। বিখ্যাত রাজকীয় উদ্যান ইয়াংমিনইয়াং-এ অধের্ক দৃশ্যে এই উত্কর্ষের পর্যায় প্রতিফলিত হয়েছে। দেবতা পর্যায় বলতে এই অর্থ বুঝায় যে, উদ্যান নির্মাণের সময় রোম্যান্টিক্স সৌন্দর্য হিসেবে গণ্য করা হয়, চীনের তাও পরিবার তত্ত্বে যে শান্তি , সুখ আর দু:খে নির্বিকার থাকার মনোভাব জোরদার করা হয়েছে তার চিন্তভাবনা চীনের রাজকীয় উদ্যানগুলোতে প্রতিফলিত হয়।যেমন ধরুন, ইয়াংমিনইয়াং উদ্যানের পংদাওইয়াওথাই , সিছুয়েন ছিংছেন সেনের গুছানদাওগুয়ান , হুবেই উদানসেনের নানইয়েনগন প্রভৃতি। চীনের ইতিহাসের বিখ্যাত মানুষের নাম অনুসারে নির্মিত উদ্যানগুলোতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকে বেশী মনোযোগ দেয়া হয়। যেমন চীনের সোং রাজবংশের সুশেনছিনের ছানলান চৌকি, সিমাগুওয়াংয়ের দুলোইয়াং প্রভৃতি। চীনের উদ্যান আর পাশ্চাত্যের উদ্যানের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, পাশ্চাত্যের উদ্যান জ্যামিতি ও গণিতের মূলনীতির উপর জোর দেয় ও স্থাপত্যকেই প্রাধান্য দেয় আর চীনের উদ্যান প্রকৃতিক দৃশ্যাবলী ও দর্শকদের অনুভূতিকে প্রাধান্য দেয় এবং প্রাধান্য দেয় প্রকৃতি ও মানুষের ঐক্যের এর সৌন্দর্য সম্ভোগের উপর।  

 

মেধা-সংস্কৃতি, শিক্ষা ও সৌন্দর্য মূল্যায়ণ

আদর্শের মুখোশ পরে তথাকথিত মূল্যবোধের নামে রাজনীতিতে যে বাণিজ্য, ধর্মের লেবাস পরিধানে যে বাণিজ্য, ধর্মকে পুঁজি করে যে বাণিজ্য, নিজেদের অতিরিক্ত লাভ ও লালসাকে চরিতার্থ করবার জন্য যে বাণিজ্য, যে বাণিজ্যের নামে আমাদের শিক্ষা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের স্বাস্থ্য-চিকিৎসা সব ক্ষেত্রেই যেখানে আজ সত্যিকার অর্থে অবক্ষয়ের যে ঢল নেমেছে-’রাজনীতি বাণিজ্যে’র জন্যে সে বাণিজ্যের বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। তবে অবশ্যই বাণিজ্য থাকবে। কিন্তু সেই সঙ্গে থাকবে মানবিক কল্যাণ, মানুষের কল্যাণ, দেশের কল্যাণ বা দেশপ্রেম। দেশের সার্বভৌমত্ব দেশের সত্যিকার স্বার্থরক্ষায় সচেতন থাকতে হবে প্রতিনিয়ত। আন্তর্জাতিকতাবোধ কখনও দেশ প্রেমের ঊর্ধ্বে হতে পারে না। হওয়া উচিত নয়। দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে আবার উদারতা? দেশপ্রেম ও একমাত্র দেশপ্রেমকে সামনে রেখে দেশের স্বার্থ অক্ষুন্ম রেখে সবক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যকরি হলে আমরা সে ব্যবসা-বাণিজ্যকে অবশ্যই সাধু বাদ জানাবো। সম্পদ, পুঁজি, মেধা-সংস্কৃতি, শিক্ষা, সবই মানুষের কল্যাণের জন্য। যে বাণিজ্য সত্যিকার অর্থে দেশকে সমৃদ্ধ করবে অবশ্যই আমরা তার পক্ষে। পরিবর্তিত সমাজ ও পৃথিবীতে সব কিছুরই পরিবর্তন ঘটছে ও আগামীতেও ঘটবে; কিন্তু কতগুলো Fundamental basic values বোধকরি আছে ও থাকবে, থাকা উচিত চিরকাল যার সাহায্যে কোন সময়ে যেকোন পরিবেশ ও পরিস্থিতির মাঝেও মানুষ তার ব্যক্তিগত স্বার্থের চেয়েও সমষ্টির স্বার্থ, দেশের স্বার্থ, দেশের কল্যাণ ও সে সঙ্গে পৃথিবীর সব জাতি ও সব ধর্মের মানুষের কল্যাণকেই বড় করে ভাবতে শিখবে এবং এই মূল্যবোধের কোন বিকল্প নেই। values বলতে মূল্যবোধ বলতে আমি এই Fundamental “feelings” ‘বোধকেই বোঝাতে চেয়েছি। যে মূল্যবোধ, যে নৈতিকতা, যে ভালো মন্দের বিচার ক্ষমতা মানুষকে পশু থেকে আলাদা করে রাখে তাই বোধ করি প্রকৃত মূল্যবোধ। আমার এই মত বা ধারণা সঠিক হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে মূল্যবোধ তৈরিতে কোন বিশেষ শিক্ষক বা কিছু সংখ্যক শিক্ষকের অবদানের কথা অস্বীকার করার নয় কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় বোধ করি একজন ছাত্রকে তার নৈতিক মূল্যবোধ তৈরিতে তেমন কোন সাহায্য করতে পারে না এবং তা বোধ করি সম্ভবও নয়। আমাদের দেশেও নয়। উন্নত দেশেও নয়। এখানে একজন ছাত্র যখন প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসে তখন তার বয়স কত? ১৯/২০ তো হবেই। একজন ছাত্র নবীন বয়সে তার জীবনের ভিত্তি গড়ার যে শিক্ষা ইতিমধ্যেই পেয়ে এসেছে তার প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্কুল ও কলেজ থেকে তার পারিবারিক পরিবেশ থেকে সেই শিক্ষা ও দীক্ষার ভিত্তিভূমির ওপরই তো তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমারত গড়ে উঠবে।

 

সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্ব একত্রীকররণ

দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয় যে আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি যেন দিনে দিনে ‘ব্যবসা-বাণিজ্যের সংস্কৃতি’তেই পরিণত হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যই যেন আমাদের সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রিত করছে। তাদের কৃপা ও অনুকম্পার ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। এটা দুঃখের। এটা দুর্ভাগ্যের। এ অবস্থা কোনক্রমেই চলতে দেয়া উচিত নয়। তবে আশার কথা যে আমাদের বাংলাদেশের কোন নিজস্ব টিভি চ্যানেলেই এখন পর্যন্ত এমন কোন নাটক, সঙ্গীত বা নৃত্যানুষ্ঠান প্রদর্শিত হয়নি যা দেখে মনে হয়েছে যে আমাদের দেশের মেয়ে শিল্পীদের পরিধানের বস্ত্রের বড়ই অভাব। পাশ্চাত্যের দৃষ্টি থাকুক- নারী দেহের গড়নের ওপর। কিন্তু প্রাচ্যের দৃষ্টি নিবন্ধ থাকুক নারীর শিল্প-সৌন্দর্যের সুষমার ওপর, ব্যঞ্জনার ওপর। তাছাড়া এখনও পৃথিবীতে একজন পুরুষের সত্যিকার সৌন্দর্য্য ও ব্যক্তিত্ব যদি বিবেচিত হবার অধিকার রাখে তার বিদ্যা, মেধা ও মননের ওপর তাহলে একজন নারীর সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্ব কেন বিবেচিত হবে শুধু তার হাত, পা, হাঁটুর গড়নের ওপর? কিন্তু দিনে দিনে তাই তো হচ্ছে। টাকা এখন নারীকে শুধু পণ্য হিসেবে বিবেচনা করতে চাইছে। কিন্তু টাকা কোনভাবেই আমাদের নিজস্ব শিল্প, রুচি ও নান্দনিকতাকে যেন বিনষ্ট করতে না পারে, আমাদের নারীদের বিবস্ত্র করে তাদের ডিগনিটি বিনষ্ট করতে না পারে, বিশেষ করে নারী শিল্পীদের। শিল্পকর্ম আর সার্কাস এক নয়। হতে পারে না। টাকার চাবুকাঘাতে নারীর দেহ প্রদর্শনে বাধ্যকরণও এক ধরনের নারী নির্যাতন।

 

সৌন্দর্য ও মূল্যবোধ

ধর্মীয় চিন্তাবিদগণ হিজাবকে নারীদের গর্ব-অহঙ্কার এবং ব্যক্তিত্বের সনদ বলে মনে করেন। ইসলামের দৃষ্টিতে নারী হলো ফুলের মতো,আর হিজাব তার সুগন্ধিময় অস্তিত্বের মহামূল্যবান পবিত্রতাকে অসুস্থ মনের অধিকারী দুষ্ট প্রকৃতির লোকদের অত্যাচার থেকে তাদের সেই সৌন্দর্য ও মূল্যবোধকে রক্ষা করে। অধ্যাপক শহীদ মোর্তজা মুতাহহারী বলেছেন-একজন নারী যখন হিজাব পরে নিজের ব্যক্তিত্ব,গাম্ভীর্য ও পবিত্রতা বজায় রেখে বাসা থেকে বের হয়,তখন কোনো অসৎ লোক অর্থাৎ যারা সাধারণত নারীদের উত্যক্ত করে সেইসব বাজে লোকজনের বিবেকও তাকে বিরক্ত করার সায় দেয় না। তাছাড়া হিজাবটা নিজের জন্যেও নিরাপদ।হিজাবধারী নারীরা নিজস্ব দৈহিক সৌন্দর্যকে ঢেকে রাখার কারণে সামাজিক বহু ক্ষয়ক্ষতি বা বিপদ থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে। ইমাম আলী (আ) বলেছেন-মহিলাদের পূর্ণ হিজাব তাদের নিরাপত্তা বাড়িয়ে দেয়।

 

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি আমাদের এই বাংলাদেশ। বছরে ছয়টি ঋতু পালাক্রমে প্রকৃতিকে আপন সাজে সজ্জিত করে। আবার সেই সঙ্গে উপহারও দেয় রূপ-রস-গন্ধে ভরা সুস্বাদু ফলের ভাণ্ডার। আমাদের দেশীয় ফল হচ্ছে—আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, নারিকেল, আনারস, বেল, কমলা, আতা, আমলকী, আমড়া, জলপাই, পেয়ারা, পেঁপে ইত্যাদি। ফলের চাহিদা মেটাতে দেশীয় ফলের পাশাপাশি বিদেশি ফল প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, যেমন—আপেল, কমলা, আঙুর, নাসপাতি, ডালিম, খেজুর ইত্যাদি। বাংলাদেশের ফলের মধ্যে নারিকেল, কলা সারা বছরই পাওয়া যায়। কিন্তু অন্য ফলগুলো ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে জন্মে।

 

 

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

ন্যাশনাল পার্ক প্রকৃতিপ্রেমীদের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এক অনন্য স্থান। বন-পাহাড় আর জীবজন্তুর অভয়ারণ্য। পাহাড়ি এই জনপদে রয়েছে খাসিয়াসহ বিভিন্ন উপজাতীয়দের বসবাস। কাছ থেকে দেখলে মনে হবে ঘুমন্ত সবুজ পাহাড়ের অতন্দ্র প্রহরী হলো এসব আদিবাসী। পাহাড়ের পাদদেশে এই জনগোষ্ঠীর যুগ যুগ ধরে প্রকৃতির পরিচর্যা করে লাখো বৃক্ষ লালন-পালন করছে। এর ফলে এসব পাহাড়ে দিন দিন নতুন বৃক্ষ সতেজভাবে বেড়ে উঠছে। পাহাড়ি গাছে লতিয়ে বেড়ে ওঠা পানচাষ করে খাসিয়াদের জীবন চলে। ঐতিহ্যগতভাবে বন, পাহাড়, সবুজ গাছগাছালি ও প্রকৃতির সঙ্গে খাসিয়াদের এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। প্রকৃতির আপনজন হিসেবে অতি কাছে বসবাসকারী খাসিয়ারা তাদের মতোই সভ্যতার অনাদরে প্রকৃতির আপন খেয়ালে বেড়ে ওঠা বৃক্ষরাজিকে সন্তানতুল্য মনে করেন। পাহাড়ি শীতল ছায়ায় বেড়ে ওঠা এসব পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মননশীলতাও অত্যন্ত কোমল।লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্কে এশিয়া মহাদেশের বিরল প্রজাতির একটি গাছ আছে, যার নাম ক্লোরোফর্ম বৃক্ষ। এটি ভূমণ্ডলের একমাত্র আফ্রিকার বন ছাড়া আর কোথাও দেখা যায়নি। এককথায় বলা যায়, দুর্লভ নেশার গাছ। যার পাতার গন্ধে মানুষ নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়ে গাছতলায়। অনেকেই এই গাছকে ঘুমপাড়ানি গাছ বলে ডেকে থাকেন। এই গাছটি লাউয়াছড়া ফরেস্ট রেস্ট হাউসের পার্শ্বে রয়েছে। বর্তমানে গাছটির বয়স দেড়শ’ বছর। বয়সের ভারে পাতাগুলোতেও তেমন সতেজতা নেই। তাই তেজও অনেক কমে গেছে। লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্কের অন্যতম আকর্ষণ ক্লোরোফর্ম এই বৃক্ষটি। মূলত যদিও তার তেজষক্ষমতা কমে আসছে; কিন্তু এখনও এই বৃক্ষটির নিচে দাঁড়ালে গরমের সময় অনেক ঠাণ্ডা অনুভব করা যায়।  লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্কে নিসর্গ নামের একটি প্রকল্প আছে। তাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ গাইড রয়েছে। এই প্রকল্পে একটি তথ্যকেন্দ্রও রয়েছে। এখানে লাউয়াছড়া বনের সব তথ্য পাওয়া যায়। আরও কয়েক কিলোমিটার দূরে গেলে দেখা যায়, চা বাগানের ভেতরে বিশাল একটি লেক। লেকটির নাম মাধবপুর লেক। মাধবপুর লেকের সন্নিকটে উপজাতীয় কালচার একাডেমি রয়েছে। বিভিন্ন উপজাতীয় সম্প্র্রদায়ের আচার-অনুষ্ঠান আর সাংস্কৃতিক জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কমলগঞ্জ উপজাতীয় সাংস্কৃতিক একাডেমির চার দেয়াল। এখানকার উপজাতীয় সম্প্রদায়কে নিয়ে তাদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে সময় কাটান এবং সুখ আহরণ করতে পারবেন আপন মনে। সবুজ প্রকৃতি আর পাহাড়ের মাঝে বয়ে চলা আঁকাবাঁকা রেলপথও আপনাকে মুগ্ধ করে দেবে। প্রকৃতির লীলায়িত নন্দন কানন, নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বর্ণময়, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং তাদের সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যমণ্ডিত সংস্কৃতি নিয়ে গঠিত শ্রীমঙ্গল। পাহাড়ে দাঁড়িয়ে দূরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে পাহাড়ের ওপরে উঠতে হবে আপনাকে। ‘যতদূর চোখ যায় ওই দূর নীলিমায় চোখ দুটি ভরে যায় সবুজের বন্যায়’।

 

মানসিক সৌন্দর্য সৃষ্টি

সুস্বাস্থ্য, সুঠামদেহ, মায়াবী চেহারা, লাবণ্যময় ত্বক তথা দুধে আলতা গায়ের বরণ, ডাগর ডাগর আঁখি, সুদর্শন ব্যক্তিরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল সমাজেই সমভাবে সমাদ্রিত। পক্ষান্তরে, প্রাকৃতিকভাবে বাহ্যিক গঠন যার আকর্ষণীয় নয়, কিংবা দুর্ঘটনা যার রূপসৌন্দর্য কেড়ে নিয়েছে তাকে আমরা শুধু অবজ্ঞা, অবহেলা ও দু’চোখভরা ঘৃণাই দিতে শিখেছি। আর অসুস্থতা যার বেঁচে থাকার আশার প্রদীপকে নিস্প্রভ করে দিয়েছে। ফলে পৃথিবীর আলো-বাতাস যার কাছে নিমের চেয়েও অধিক তিক্ত মনে হচ্ছে।  মনোরঞ্জন কিংবা চিত্তবিনোদনের উপায় উপকরণগুলো যার মনে কাটা-ঘায়ে নুনের ছিটা দিয়ে যাচ্ছে। তার সাথে আমরা কি সুন্দর আচরণইনা করছি। তার দুঃখ-কষ্ট আমদের কোমল হৃদয় ব্যথাতুর(!)করে ফেলেছে। তাই আমরা গবেষণা করে তার জন্য Euthanasia বা Mercy Killing এর মত মনুষ্যত্ববিবর্জিত অত্যাধুনিক উপহার নিয়ে এসেছি। এসবের পশ্চাতে যে জিনিসটি মুখ্য ভূমিকা পালন করছে তাহলো আমরা আমাদের মূল্যায়নে মানুষের ভেতরের সৌন্দর্যের সুবিশাল সৌধকে দৃষ্টির অন্তরালে আচ্ছাদিত রেখে শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্যের ক্ষুদ্র ইস্টকের মোহে মুগ্ধ হয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে শিখেছি। আর এখানেই আমাদের সীমিত ও অদূরদর্শী দৃষ্টির সাথে ইসলামের সুদূরপ্রসারী দৃষ্টির মৌলিক পার্থক্য। অথচ প্রকৃত অবস্থা এমন ও হতে পারে যে, আমাদের বিচারে সুস্থ সবল লোকটি আধৌ কোন ভাল মানুষ নাও হতে পারে। একটু মনোযোগ নিবিষ্ট করুন নিন্মোক্ত আয়াতে। আল্লাহ বলেনঃ “আপনি যখন তাদেরকে দেখেন, তখন তাদের দেহাবয়ব আপনার কাছে প্রীতিকর মনে হয়”(সূরা আল-মুনাফিকুনঃ৪)।


বৌদ্ধিক মূল্যবোধ

আমরা সকলেই মূল্যবোধ শব্দটির সাথে পরিচিত। কিন্তু এর নাম প্রকাশ সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই ধারণা স্বচ্ছ নয়। ব্যক্তির মূল্যবোধ তাঁর আচরণিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই প্রকাশ পায়। কাজেই ব্যক্তির অন্ত:দৃষ্টির বিকাশের মাধ্যমে মূল্যবোধ অনুধাবন করতে হবে। তারপর নিজস্ব প্রচেষ্টায় তা অব্যাহত রাখতে হবে। ব্যক্তির জীবনে একদিনেই মূল্যবোধ অর্জিত হয় না। যথার্থ শিক্ষা অব্যাহত প্রচেষ্টা নিয়মিত অনুশীলন এবং চরম বুদ্ধিমত্তার সক্রিয় সমন্বয়ের মাধ্যমেই ব্যক্তির মাঝে মানবীয় মূল্যবোধ অর্জিত হয়ে থাকে। শিক্ষার্থীর আদর্শ জীবন গঠনের মাধ্যমেই মূল্যবোধের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জিত হয়ে থাকে। মানবীয় মূল্যবোধ অর্জনের জন্য শিক্ষা জীবনই উৎকৃষ্ট সময়। এ সময় মূল্যবোধ শিক্ষার সঠিক প্রতিফলন ব্যক্তির মাঝে প্রতিফলিত হলে তা তার সারা জীবন সক্রিয় থাকে। শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনে মূল্যবোধ অর্জনের ক্ষেত্রে আলোচিত উপায়গুলো বিবেচনায় রাখা যায়।


আমাদের প্রত্যহিক জীবনে বৌদ্ধিক মূল্যবোধের অবস্থান

শিক্ষা জীবন উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে যথার্থ মূল্যবোধ অর্জন সম্ভব নয়। যথার্থ মূল্যবোধ অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীর অভিভাবক, শিক্ষক এবং পিতামাতাকে যথার্থ মানবীয় আদর্শের অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় ব্যক্তি হিসেবে প্রতিফলিত করতে হবে। পারিবারিক পরিবেশে শৃঙ্খলা, শান্তি, মমত্ববোধ, সম্প্রীতি এবং স্নেহ মমতায় বাস্তব ভিত্তিক প্রতিফলন থাকতে হবে যার মধ্য দিয়ে শিশুরা বেড়ে ওঠবে ও বিকশিত হবে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সামনে বেহায়াপনা, অশ্লীলতা এবং অনৈতিকতার কোন নজির প্রতিস্থাপন করা যাবে না যাতে তারা অনুকরণীয় কার্যরূপে মনে রাখতে না পারে। সমাজের গুরুজন এবং বয়োঃজ্যেষ্ঠদের আচরণিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং নির্দেশনার মাধ্যমে ছোটদের মধ্যে মূল্যবোধ গড়ে তোলা যায়। যা সত্য তাই সুন্দর ও কল্যাণকর এ উপলব্ধির মধ্য দিয়েই ব্যক্তির সাথে মূল্যবোধ কাজে লাগানো যায়। মূল্যবোধ অর্জনে ব্যক্তির আবেগিক আগ্রহকে প্রধান উপায় হিসেবে কাজে লাগানো যায়। শিক্ষার্থীর বিকাশ এবং অনুধাবন শক্তির সম্প্রসারণ করে মূল্যবোধ জাগ্রত করা যায়। ধর্মীয় অনুশাসন নীতি অনুসরণের মাধ্যমে মূল্যবোধ সৃষ্টি করা যায়। বিষয় ভিত্তিক জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে মূল্যবোধ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দেয়া যায়। চারিত্রিক মাধুর্যতা এবং কাঙিক্ষত আচরণের দৃঢ়তা অনুসরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা যায়। মহৎ মনীষীদের জীবন অধ্যয়ন অনুকরণ এবং অনুসরণের মাধ্যমেও আজকের শিক্ষার্থীদের মাঝে মানবীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করা সম্ভব।


 

জাতিগত মানবীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা

বৌদ্ধিক মূল্যবোধ শিক্ষায় শিক্ষকের ভূমিকা সর্বাধিক। শিক্ষক সমাজের পরিচালক, নির্দেশক, নিয়ন্ত্রক, আলোকবর্তিকা, কাণ্ডারী, নতুন নতুন সমাজ মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষকের শিক্ষাদানের মধ্য দিয়েই সমাজ সংস্কারের কার্যটি ত্বরানিত হয়ে থাকে। এ পৃথিবীতে যে কয়টি সমাজ বিপ্লব সাধিত হয়েছে তার সব কয়টির মূলে রয়েছে শিক্ষকের অনুপ্রেরণা এবং প্রজ্ঞাময় নির্দেশনা। কাজেই শিক্ষককে বাদ দিয়ে সমাজ তথা জাতীয় মূল্যবোধ কিংবা জাতিগত মানবীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। শিক্ষক সমাজের শিক্ষা তথা জ্ঞান আলোকে সম্প্রসারণের মূল কেন্দ্র বিন্দুতে অবস্থান করেন। তাকে কেন্দ্র করেই প্রজন্মের পর প্রজন্মের মাঝে শিক্ষা ধারার চেতনা তথা মূল্যবোধ শিক্ষার আলো প্রতিফলিত হয়ে থাকে। সুতরাং একথা পরিষ্কার যে শিক্ষার্থীর মূল্যবোধ শিক্ষায় শিক্ষকের ভূমিকা অগ্রগণ্য। আমরা জানি শিক্ষক শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে তাদের মাঝে বৌদ্ধিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে থাকেন। এক্ষেত্রে শিক্ষকের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, দক্ষতা, প্রজ্ঞা, শিক্ষার্থী শিক্ষকের নির্দেশনায় জ্ঞানের সামগ্রিক চর্চা করে তাদের বৌধিক বিকাশকে আরো বেশি গতিশীল করতে পারেন। যার মধ্য দিয়ে তাদের মাঝে চরম মূল্যবোধ জাগ্রত হয়। শিক্ষার্থীদের বয়স, যোগ্যতা, মেধা, প্রেরণা, আগ্রহ এবং পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী শিক্ষক শিক্ষণীয় বিষয়বস্তু নির্বাচন করে থাকেন। এক্ষেত্রে শিক্ষক শিক্ষার্থীর জীবনের জন্য চরম মূল্যবোধ অর্জনে সহায়তা করতে পারেন। এমন সব শিক্ষণীয় বিষয়বস্তুকে তাদের শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত করে মূল্যবোধ শিক্ষার সম্প্রসারণ করতে পারেন। এতে করে প্রাপ্ত শিক্ষা হবে তাদের জন্য উপযুক্ত।


 

সঙ্গবদ্ধ আচার-আচরণ

সামাজিক সত্তার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে সামাজিক চেতনা। সামাজিক সত্ত্বা হল একটি সমাজের সামগ্রিক আবহ, যার মধ্যে প্রাকৃতিক পরিবেশকেও যোগ করা যায়। মানুষের ব্যক্তি চেতনার সমন্বিতরূপ হল একটি জনগোষ্ঠির সামাজিক চেতনা, যদিও ব্যক্তি চেতনা সবসময় সামাজিক চেতনার প্রতিনিধিত্ব করেনা। ব্যক্তি চেতনার প্রাথমিক ভিত্তি হল পারিবারিক আবহ। একটি শিশু জন্মের প্রাক্কালে যেমন তার আত্মজেরা শিশুর উপযোগী পরিধেয় বস্ত্র তৈরী করে রাখে, ঠিক তেমনি তার জন্মের পূর্বে তার পরিবারে তার জন্য বিশ্বাস-চেতনা-মূল্যবোধের একটি অদৃশ্য অবয়ব তৈরী হয়ে তাকে, জন্মের পর তৈরী পোশাকের মত ধীরে ধীরে নবজাতকও সে অবয়বে প্রবেশ করে। অতঃপর ক্রমে যখন এ শিশু আরো বেড়ে ওঠতে থাকে এবং সে ক্রমে পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে সামাজিক আঙ্গিনায় প্রবেশ করে, তখন মানুষের সঙ্গবদ্ধ আচার-আচরণ তার উপর প্রভাব ফেলে। পারিবারিক চেতনার অদৃশ্য অবয়বের মত যে সমাজের সে বাসিন্দা, সে সমাজও তার জন্য চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধের একটি অবয়ব আগাম তৈরী করে রাখে, তাকে পরিবর্তন নয়, তার মধ্যেই সে নিজেকে মানিয়ে নিতে বাধ্য হয়। ধর্মীয় বিশ্বাস একান্ত ব্যক্তি বিশ্বাস হলেও জন্ম লগ্ন থেকে প্রত্যেক ধর্ম ধর্মানুসারীদের গোষ্ঠীবদ্ধ আচার-আচরণের কারণে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এভাবে মানুষের চিন্তা চেতনা একটি সামাজিক সত্ত্বার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এখন আমরা যদি বিশ্বপ্রেক্ষিতে বিশ্ব মানব সমাজ ও সভ্যতার বিকাশের দিকে তাকাই, তাহলে আমরা দেখব এ বিকাশ নানা ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক কারণে সমসত্ত্ব নয়, বরং নিদারুন অসম। বিশ্বের কোন কোন দেশে সমাজ ব্যবস্থা এখনো মধ্যযুগে অবস্থান করছে শুধু চিন্তা চেতনাগত ভাবে নয়, উৎপাদন সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। ফলত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা যেখানে পশ্চাদপদ, সেখানে মানুষের চিন্তা চেতনা ও পশ্চাদপদ হতে বাধ্য। বিজ্ঞানের আধুনিক প্রযুক্তি যদিও সে সকল সমাজে পৌছে গেছে উপছে পড়া তত্ত্বানুসারে, কিন্তু বিজ্ঞানের দর্শন সেখানে এখনো জায়গা করে নিতে পারেনি। নির্মম ফলশ্র“তিতে ঐ সকল পশ্চাদপদ সমাজ এখনো মধ্যযুগীয় চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধ এর জন্ম, বিকাশ ও লালনের ঊর্বর ক্ষেত্র হয়ে আছে।

অগ্রযাত্রা অপ্রতিরোধ্য

বিশ্ব মানবগোষ্ঠী, তার সমাজ ও সভ্যতা, জন্মলগ্নের অবস্থায় দাঁড়িয়ে নেই। তার ক্রম বিকাশ মানব সভ্যতাকে বিকাশের এক অভাবনীয় পর্যায়ে উপনীত করেছে। মানুষের এ অগ্রযাত্রা অপ্রতিরোধ্য এবং তার গন্তব্য নিঃসীম। প্রকৃতিকে জয় করে মানুষের জীবনকে আরো সম্ভাবনাময়, সহজ ও সুখপ্রদ করতে হলে আমাদের এগিয়ে যেতেই হবে। সেক্ষেত্রে বিশ্বপরিমণ্ডলের তুলনায় আমাদের মত পশ্চাদপদ দেশগুলোর এগিয়ে যাওয়ার তাগিদত অপরিহার্য। কারণ বিশ্ব প্রেক্ষিতে আমরা ইতোমধ্যেই অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের কাক্সিক্ষত অগ্র যাত্রার যে রথ, নিঃসন্দেহে তা তো ধর্ম নয়, বিজ্ঞান। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হল ধর্ম নামক বিষয়টি আমাদের মত পশ্চাদপদ দেশে তথা সমাজে শুধু নিরেট বাস্তবতা নয়, মানুষের জীবনাচরণের অন্যতম নিয়ন্তাও। এখানেই প্রশ্নটা আসে, তাহলে আমরা কিভাবে এগুবো। দুই রথে দু’পা রেখে এগুনো যেমন যাবে না, তেমনি ধর্মীয় রথে ওঠে মোক্ষলাভের পরম চিন্তায় যে বিশাল জনগোষ্ঠী আত্মনিমগ্ন হয়ে আছে

ধর্মীয় অনুভূতি

জ্ঞানগতভাবে সত্যের সাথে মিথ্যা, কিংবা ভুলের সাথে শুদ্ধের যেমন কোন সমন্বয় বা সমঝোতা চলেনা এবং এ জাতীয় প্রশ্নই বরং অবান্তর, ঠিক তেমনি ধর্ম তথা বিশ্বাসের সাথে বিজ্ঞানের সমন্বয় বা সমঝোতার কোন সুযোগ নেই। এখানে সাংঘর্ষিক হলেও বিজ্ঞানের চর্চা অব্যাহত থাকবে। বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিস্কার বা অগ্রগতি যদি প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসের ভীতে আঘাতের পর আঘাত হানে, কারো তথাকথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে লাগে এবং কারো আজন্ম লালিত বিশ্বাসে ভীত উপড়েও ফেলে, তবুও বিজ্ঞানের আবিস্কারকে অস্বীকার করা কিংবা ধর্মের আলোকে তাকে জায়েজ করে নেওয়ার কোন সুযোগ নেই এবং তার প্রয়োজনও নেই। বরং তা করতে গেলে মানুষের চিন্তা সীমাবদ্ধ ও বুদ্ধি আড়ষ্ট হয়ে পড়বে। বিজ্ঞানের যে অভিযাত্রায় তাকে বাঁধাহীনভাবে চলতে দিতে হবে জ্ঞানের রাজ্যে। তার অগ্রগতির মাধ্যমে অজ্ঞনতার আধাঁর ধীরে ধীরে তিরোহিত হবে।



আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত

আমরা পুর্বেও আলোচনা করেছি যে, বিজ্ঞানের এ চরম উৎকর্ষতার যুগেও পৃথিবীর সর্বাংশে আর্থ-সামাজিক বিকাশ সমভাবে ঘটেনি। একই ভাবে বিজ্ঞান ও জ্ঞানের বিকাশেও আছে মাত্রাগত তারতম্য। এখন জ্ঞানগত দিক থেকে আমরা যেমন বিজ্ঞান ও ধর্মের সাথে কোনরূপ সমন্বয় সমঝোতা ছাড়া এগুতে চাই, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিতে তা করতে গেলে এগুনোই যাবেনা। সমাজে বিদ্যমান সামাজিক চেতনা, তা যত পশ্চাৎপদ হউক না কেন, তাকে এক ধাক্কায় গুড়িয়ে দেওয়া যাবে না। বরং তা করতে গেলে হিতে বিপরীত হবে প্রতিক্রিয়ায় নতুন করে চাঙ্গা হবে ধর্মীয় বিশ্বাস। আবার সমাজের প্রত্যেক মানুষকে বৈজ্ঞানিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ বা সচেতন করে আমরা উন্নয়ন অগ্রগতির পথে এগুবো, সে ধারণাও অবাস্তব। এখানেই আসে ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের সমন্বয়ের প্রশ্নটি। তবে এ সমন্বয় অবশ্যই বিজ্ঞানের কোন সত্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে নয়, তা প্রকাশে “সহনীয় সীমারেখা” মেনে চলে। কথাটি একটু খোলাসা করি। বিজ্ঞানে এমন কিছু সত্য আছে বা আবিস্কৃত হবে, যা ধর্মের অস্থিত্বের উপর সরাসরি আঘাত হানবে। সে সকল সত্য প্রকাশে আমাদের যে কৌশল নিতে হবে, তাহলো যু্ক্তি-তর্ক, কার্য-কারণ চর্চা বা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমজনতাকে ক্রমান্বয়ে প্রস্তুত করে ধীরে ধীরে নব আবিস্কৃত সে সত্যকে তার সামনে তুলে ধরা, যাতে আজন্ম বিশ্বাস আচমকা ভেঙ্গে গেল বলে তাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে না পড়ে। এ পদ্ধতিটাকে আমি ‘‘সত্য প্রকাশের সহনীয় মাত্রা’’ বলতে চাচ্ছি, যদিও আমার জানা নেই এ জাতীয় কোন প্রত্যয় আগে কেহ ব্যবহার করেছেন কিনা। আধুনিক ধর্ম-ব্ত্তোরা তার বিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখার শেষ চেষ্টা হিসাবে যতই বিজ্ঞানের আলোকে ধর্মকে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পাক না কেন, বিষয়টাকে ধর্তব্যের মধ্যে না এনে আমাদের কেবল বৈজ্ঞানিক সত্যটাকে আমজনগণের কাছে তুলে ধরতে হবে, যুক্তি-তর্ক ও কার্য-কারণ ব্যাখ্যা করে। ধর্মের বিরুদ্ধে সরাসরি কোন মন্তব্য করার প্রয়োজন নেই। তা আপনি-আচরি শুকিয়ে যাবে। কিন্ত এক্ষেত্রেও আমাদের অবিচল থাকতে হবে রণনীতিতে, অর্থাৎ আমাদের লক্ষ্যে। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি আমজনগনকে বিজ্ঞানমনষ্ক করার একটি সচেতন প্রয়াস চালাতে হবে বিরামহীনভাবে। তাতে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অগ্রগতির সাথে সাথে বৈজ্ঞানিক চেতনার বিকাশের পথও হবে সুগম। এ পদ্ধতিতে অনুশীলনের ফলে এমন একটি সময় আসবে, তখন বিজ্ঞানের সাথে ধর্ম, যুক্তির সাথে বিশ্বাসের এবং কার্য-কারণের সাথে অলৌকিকত্বের সমন্বয়ের প্রশ্নটা অবান্তর হয়ে ওঠবে।


বুদ্ধিবাদ

বুদ্ধিবাদের এই আঁটসাঁট ধরণ প্রথম আক্রান্ত হয় ইংল্যান্ডে। সেখানে লক, হিউম; পরে জেরেমি বেনথাম জিনিসের বাস্তব প্রকৃতির মধ্যে বৌদ্ধিক সত্তার মত কোন কিছুর অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। তারা বলেন, যেহেতু কেবলমাত্র সংবেদন দিয়েই সব তথ্য বাহিত হয়, সুতরাং বুদ্ধি জ্ঞানের স্বাধীন উৎস হতে পারে না। বড় জোর তা দিয়ে প্রাপ্ত তথ্য সাজিয়ে গুছিয়ে, বাদ-ছাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত টানা যেতে পারে। অষ্টাদশ শতাব্দীর ফ্রান্সে এই বুদ্ধিবাদ আক্রমণের স্বীকার হয় বস্তুবাদী ঘরানার হাতে। (এখানে একটা কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, মার্ক্সের পরে আমরা আজকে যেমন করে বুঝি যে, নিরেট বস্তুবাদী বা ভাববাদী দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গি বলতে কিছু নেই; ঐ সময়ে ব্যাপারটা অমন ছিল না। সে স্পেশালাইজেশন অনেক পরের কথা।) ওখানে ভলতেয়ার, দিদেরো, কঁদিলাক, হেলভেশিয়াসঞ্চরা খোলাখুলিভাবে ইংরেজ মুক্তচিন্তাবিদদের ঋণ স্বীকার করে একদম আলাদা এক ঘরানা তৈরী করেন। দার্শনিক পরিভাষাগুলোকে কেতাব থেকে নামিয়ে এই ধুলোবালির জগতে দৌড় করানোর বড় কৃতিত্ব তাদের। সন্দেহবাদী মঁতেইন তার জন্য অনেক আগে থেকেই জমি তৈরী করা শুরু করেছিলেন। এই ঘরানার বড় একটা অভ্যাস ছিল কর্তৃত্বের বিরোধিতা করা। জন লক বলেছিলেন, মানুষের বুদ্ধি স্বাধীন কিনা, তার আগের প্রশ্ন খোদ মানুষ স্বাধীন কিনা? তাঁর দেয়া আভাসকে স্পষ্ট করে ভাবতে বাধ্য করলো ফরাসি ঘরানা।

ফরাসি দেশে কর্তৃপক্ষের দিকে ভরসার অভাবেরও কারণ আছে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে তাদের ক্ষয়ক্ষতি, ঐ দেশের তুলনায় তাদের ধীরগতির অর্থনৈতিক বিকাশ, তথাকথিত কোন যোগ্য নেতৃত্বকারী শ্রেণী প্রতিনিধি না থাকা এর পেছনে খুব কাজ করেছে। প্রশ্নহীন বৌদ্ধিক সংঞ্চার মত যাজক বা ঈশ্বরতন্ত্রকেও তারা সমানভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন। তারা বুঝতে পারছিলেন, বুদ্ধি অনেক অন্যায়কেও ন্যায় বলে চালিয়ে দেয়। যেমন, এরিস্টটল বুদ্ধির বরাত দিয়েই মানুষের মাঝে দাস আর স্বাধীন মানুষের অসাম্যকে প্রাকৃতিক বলে চালিয়ে দিয়েছেন। তেমনি বাইবেলও বলছে যে, মানুষ তার আদি উৎস হতেই স্বভাবগতভাবে পাপী। এই সব বক্তব্য রাষ্ট্রে বা সমাজ সংগঠনে কিছূ মানুষের সুখ ভোগ আর বাকিদের কলুর বলদ হবার পক্ষে যুক্তি দেয়। অন্যায়কে বুদ্ধি দিয়ে যৌক্তিক বলে সিদ্ধ করতে চায়। কিন্তু বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতাকে ঠিকমতো বুঝে মিল খাওয়াতে পারলে পুরো উল্টো সাক্ষী পাওয়া যায়। সম্ভাব্য কোন সন্দেহ ছাড়াই যুক্তি দাঁড় করানো যায় যে, মানুষ স্বভাবতই ভালো, সব মানুষেরই সমান বুদ্ধি আর সব দূর্দশা আর শোষণের কারণ হচ্ছে মানুষের অজ্ঞতা। এই অজ্ঞতার কারণ অংশত স্বাভাবিক ঐতিহাসিক বিকাশের পথে উঠে আসা সামাজিক ও বস্তুগত অবস্থা, আর অংশত স্বার্থান্বেষী স্বৈরাচার আর যাজকদের হাত দিয়ে সত্যকে ইচ্ছে করে লুকিয়ে বা দাবিয়ে রাখা। কোন আলোকায়িত, পরস্বার্থব্রতী সরকারের কাজকর্ম দিয়ে তাহলে এই মন্দ প্রভাব কাটিয়ে ওঠা যায়। তাহলে মানুষের বুদ্ধি চর্চায় কর্তৃপক্ষ আর বিশেষ সুবিধার জায়গায় আসবে ন্যায়বিচার আর সাম্য; প্রতিযোগিতার জায়গায় সহযোগিতা।


আধা-অভিজ্ঞতাবাদী বুদ্ধিবাদ

আধা-অভিজ্ঞতাবাদী বুদ্ধিবাদের কেন্দ্রীয় একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। তা হল- জগতকে ব্যাখ্যা আর উন্নতি করায় বুদ্ধির প্রতি অগাধ বিশ্বাস। কারণ, মানব দূর্দশা হচ্ছে অজ্ঞতার এক জটিল ফলাফল, শুধু প্রকৃতির নয়, মানব সমাজের নিয়মেরও। একে নির্মূল করতে হলে মানব কাজকর্মে শুধুমাত্র বুদ্ধির প্রয়োগই যথেষ্ট। কাজটা সহজ নয়; কারণ মানুষ এত সুদীর্ঘকাল বৌদ্ধিক অন্ধকারের পৃথিবীতে কাটিয়েছে। সুতরাং এক ঝাঁক আলোকায়িত, জীবন ব্রতী মানুষ দরকার, যারা যুক্তিবুদ্ধির প্রয়োগ আর সত্যের অগ্রসরতার জন্য পথভ্রষ্ট বিশাল জনগোষ্ঠীর মাঝে কাজ করে যাবে। ঠিক এখানেই নতুন একটা সমস্যা দেখা দেয়। যদি মানুষের দূর্দশার কারণ হয় যুক্তি, বুদ্ধির প্রতি অবজ্ঞা, তাহলে এটাও কি সত্য না যে, এক শ্রেণীর মানুষ স্বেচ্ছায় এই অজ্ঞতাকে জিইয়ে রেখেছে? তাদের ক্ষমতার উৎসও কি এই অজ্ঞতা নয়? তাদের ক্ষমতা বহাল থাকাতেই মানুষ আজো অন্যায়, অসাম্য চিনে উঠতে পারেনি, একি সত্য না? প্রকৃতিগতভাবে সব মানুষই বৌদ্ধিক, যৌক্তিক। আর সব যৌক্তিক, বৌদ্ধিক প্রাণীরই বুদ্ধির প্রাকৃতিক নিয়মের অনুযায়ী সমান অধিকার। কিন্তু শাসক শ্রেণী, রাজা, অভিজাত, পুরুত মানুষকে চার্চের পবিত্রতা, রাজার ঐশ্বরিক অধিকার, জাতীয় গৌরব, এসব ধান্ধাবাজীর নামে বেগার খাটাচ্ছে। তারা আবেগহীন ভাবে নিজের পরিশ্রমে ছোট একটা শ্রেণীকে বিলাস, আরাম আয়েশে টিকিয়ে রাখছে। মানুষ বুদ্ধি দিয়ে চোখ খুললেই তা আর হবার নয়। সুতরাং কোন আলোকায়িত শাসকের প্রথম কাজ ঐ সুবিধাপ্রাপ্ত ধান্দাবাজ শ্রেণীর ক্ষমতা লোপ করা। তারপরও কিছু গন্ডগোল থেকে যাবে; তবে যেহেতু যৌক্তিকতা কখনো যৌক্তিকতার বিপরীতে যেতে পারে না, তাই সমাজের ক্ষুদ্র, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব সংঘাত অযৌক্তিক বলে বাদ পড়ে যেতে বাধ্য। সব মিলিয়ে মানুষ আসবে স্বাভাবিক বুদ্ধি, যৌক্তিকতার অধীনে। বুদ্ধি সর্বদাই সঠিক। প্রতিটি প্রশ্নের একটি মাত্র সঠিক উত্তর আছে, যা বুদ্ধি দিয়ে উদ্‌ঘাটন করা যায়। একবার তা বের করে ফেলতে পারলে তখন তাকে নৈতিকতা, রাজনীতি, ব্যক্তি বা সমাজ জীবনে; তারপর পদার্থবিদ্যা বা গণিতের সমস্যায় সমানভাবে প্রয়োগ করা যাবে। শুধুমাত্র তা একবার সমাধিত হয়ে গেলেই হয়; তবে যুগ যুগ ধরে টিকে থাকা প্রগতির শত্রুকে আগে অপসারিত করতে হবে

 

নৈতিক মূল্যবোধ সন্নিবিষ্ট

শিক্ষার তুলনায় পরিবেশের প্রভাবও কম নয়। মানুষ প্রকৃতির মাঝেই একটি বিষয়। মানুষের জীবনের সব কিছুকেই সাধারণ প্রাকৃতিক, পদার্থগত হাইপোথিসিস দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। এখানে অতিপ্রাকৃতিক কোন কিছুর বিন্দুমাত্র জায়গা নেই। ফরাসি দার্শনিক লা মেত্রি তাঁর প্রবন্ধে এই মতের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে। ফরাসি বিশ্বকোষ গোষ্ঠীর দিদেরো, দ্যলম্বার্ত, হলবাখ্‌, হেলভেশিয়াস, কঁদিলা মোটামুটিভাবে এই মতই মানতেন। তবে একটা ব্যাপারে সবাই তারা সমানভাবে একমত : মানুষ অন্যসব জীব থেকে আত্ম-চৈতন্যতা থেকেই ভিন্ন হয়। এই পার্থক্য সূচিত হয় তার বুদ্ধি আর কল্পনার প্রয়োগ দিয়ে, আদর্শ উদ্দেশ্য ঠিক করতে পারা দিয়ে, তার বুঝতে চাওয়া বিষয়ে নৈতিক মূল্যবোধ সন্নিবিষ্ট করাতে। এখানে একটা বড় সমস্যা দেখা দিল। সমস্যাটা হল মুক্ত ইচ্ছা আর বিভিন্ন শর্ত এবং পরিবেশের সম্পূর্ণ নির্ধারণের মাঝখানে বোঝাপড়া করা। পুরোনো কালের সেই মুক্ত ইচ্ছা এবং দৈব পরিকল্পনারই নতুন এক আঙ্গিক দেখা গেল; শুধু ঈশ্বরের জায়গায় এল প্রকৃতি। স্পিনোজা তারও আগে বলেছিলেন, একটা পড়ন্ত পাথর তার পতনের বাহ্যিক কারণগুলো না জানলে ভাবতেই পারে যে, সে তার গতিপথ স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছে। ঠিক তেমনটাই ঘটবে মানুষের ক্ষেত্রে, যদি সে তার আচরণ, সংগঠনের কারণগুলো না জানে। এমনি হলে মানুষের সমস্ত ক্রিয়াকান্ডই তো প্রকৃতির অপরিবর্তনীয় প্রক্রিয়াতেই ঘটে। যা ঘটেছে, তা পূর্বের; আর যা ঘটবে, তা বর্তমানের প্রক্রিয়ার ফল। স্বতন্ত্রের মুক্ত ইচ্ছা যতই ভালো হোক, তা ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোন পরিবর্তন আনতে পারবে না। অনেক পুরোনো ধর্মতাত্ত্বিক এই ধাঁধা ইহজাগতিক আঙ্গিকে আরো ধারালো হল। য়ুরোপীয় দর্শন জগত দুই শিবিরে ভাগ হয়ে পড়লো। একদিকে নাস্তিক, সন্দেহবাদী, ব্রহ্মবাদী, বস্তুবাদী, বুদ্ধিবাদী, গণতন্ত্রী, উপযোগবাদী; আর অপরদিকে ধর্মওয়ালা, অধিবিদ্যাবাদী, বহাল ব্যবস্থার সমর্থক আর সাফাই গানেওয়ালা। আলোকায়ন আর কেরানীতন্ত্রের মাঝে ফাটল এত ব্যাপক আর লড়াই এত তীব্র হল যে, প্রত্যেক শিবিরের ভেতরকার পার্থক্যগুলো একরকম অপরিলক্ষিত রইলো।

 

জাগতিক সম্পদের বৈজ্ঞানিক বন্টন

পরবর্তী শতাব্দীর র‌যাডিকেল বুদ্ধিজীবীদের কেন্দ্রীয় মত হয়ে রইলো। তারা মানুষের মাঝে শত দুরবস্থাতেও বিদ্যমান শুভত্বের প্রচার করতে লাগলো। বলতে রইলো যৌক্তিক শিক্ষা আর বর্তমান দূরবস্থা হতে মানুষকে উদ্ধার করে ন্যায়সঙ্গত সমাজে জাগতিক সম্পদের বৈজ্ঞানিক বন্টনের কথা। আরো মনে রাখতে হবে যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর বৌদ্ধিক জগত গত শতাব্দীর গাণিতিক ও পদার্থবিদ্যার ব্যাপক অগ্রসরতা দিয়ে প্রভাবিত ছিল (কেপলার, গ্যালিলিও, দেকার্ত, নিউটন)। ফলে ওই রকম নিখুঁত প্রণালী সমাজের ক্ষেত্রেও খোঁজ হতে লাগলো। ভলতেয়ার হয়ে উঠলেন মানব ধর্মের অবিসংবাদিত আদি পুরুষ। চরম শ্লেষ আর হাসির হুল্লোড় দিয়ে কিংবদন্তীর বীরের মত তিনি লড়লেন ক্যাথোলিকবাদ আর কেন্দ্রগত শাসনের বিরুদ্ধে। জীবিতকালে তাঁর সাথে জাঁ জাঁক রুশোর প্রচন্ড রেষারেষি ছিল। তবে এও সত্য, ভলতেয়ার যদি হন মানব ধর্মের স্রষ্টা তাহলে রুশোই তার সবচেয়ে বড় প্রেরিত পুরুষ। মানুষ সম্পর্কে তার মত ঐ কালের র‌্যাডিকেলদের চাইতে একদম অন্যরকম ছিল। বলা যায়, তিনি বুদ্ধি আর পর্যবেক্ষণের বিনিময়ে মানব ইচ্ছাকে মহিমান্বিত করেছিলেন। সমস্ত মানবিক প্রতিষ্ঠান তার কাছে ছিল মানুষের নিজেদের সুবিধার জন্য করা স্বেচ্ছা সামাজিক চুক্তি। তার মনে হয়েছিল- এই সভ্যতাই মানুষের দূর্দশার মূল। ব্যক্তি সম্পত্তির ধারণাহীন, প্রকৃতির মাঝে সুখে বাস করা মানুষদের মাঝে যে বদমাশ প্রথম লাঠি গেড়ে বললো- এ জমি আমার, সেই প্রথম সভ্য মানুষ। ঔপনিবেশিক শাসনের বাংলা বৌদ্ধিক চর্চার অন্যতম পুরুত বঙ্কিমচন্দ্রেরও মনে হয়েছিল- রুশোর সামাজিক চুক্তি বইটিতে ফরাসি বিপ্লবের যজ্ঞে আহুতি মন্ত্র ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শিল্প মানস এবং সমাজ বিদ্রোহীরা নিজেদের প্রকাশের জন্য তার কাছে অনেকাংশে ঋণী। রোমান্টিকদের প্রথম প্রজন্ম ফ্রান্সের বিপ্লবী ইতিহাস আর লেখাপত্রের মাঝেই অনুপ্রেরণা খুঁজতেন। এদের মাঝে ইংল্যান্ডের ওয়েলশ ম্যানুফেকচারার রবার্ট ওয়েন ছিলেন সবচাইতে একাগ্র আর প্রভাবশালী। তাঁর জার্নালের শিরোনামের ওপরে খোদিত ছিল নতুন নৈতিক জগত। নিউ ল্যানার্কে তাঁর নিজের কাপড়ের কলে তিনি আদর্শ অবস্থা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন কর্ম ঘন্টা কমিয়ে, স্বাস্থ্য ও সঞ্চয় খাত খুলে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বিগত ওয়েন ছিলেন বুদ্ধিবাদের ধ্রুপদী যুগের শেষ প্রতিনিধি।

 

 

 

ধর্মীয় মূল্যবোধ

সমাজসেবার ধরন কী হওয়া উচিত, এ ব্যাপারে আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছে”নিশ্চয়ই তোমাদের প্রচেষ্টা (সমাজসেবাও) বিভিন্ন ধরনের। তবে যে ব্যক্তি দান করে, আল্লাহর প্রতি তার কর্তব্য যথাযথভাবে সম্পাদন করে এবং আল্লাহর ভয়ে সমস্ত মন্দ ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে থাকে আর যা কিছু ভালো ও কল্যাণকর তা সঠিক বলে মেনে নেয়, আমি অবশ্যই তার জন্য সহজ করে দিই সুখ-শান্তির পথ। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কার্পণ্য করে এবং নিজেকে বেপরোয়া মনে করে, আর যা কিছু উত্তম ও কল্যাণকর তা মেনে নিতে অস্বীকার করে, আমি অবশ্যই তার জন্য সহজ করে দেব কঠোর পরিণামের পথ। যেহেতু সে ধ্বংস হয়েই যাবে, তখন তার ধন-সম্পদ কোনো কাজে আসবে না। নিশ্চয়ই আমার দায়িত্ব সঠিক পথের সন্ধান দেওয়া, পথ প্রদর্শন করা। আর আমারই আয়ত্তে রয়েছে পরকাল ও ইহকাল।” (সুরা আল-লাইল চার থেকে ১৩ আয়াত)। সমাজ সেবার উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির মাধ্যমে ছওয়াব লাভ করে দুনিয়া ও আখিরাতের কামিয়াবি অর্জন। এ ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে সমাজসেবামূলক কাজ করলে (বাহবা, দানবীর, রাজনৈতিক বা সামাজিক সুখ্যাতি ইত্যাদি) তা পাওয়া যাবে বটে, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালের মুক্তি কিন্তু পাওয়া যাবে না! তবে হ্যাঁ, স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কাজটি করে পাশাপাশি যদি কেউ বাহবা পায়, পায় আরো কিছু, তা কিন্তু দোষের নয়। এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনামূলক ঘোষণা হচ্ছে”যে নিজের অর্থ-সম্পদ দান করেছে আত্দশুদ্ধির ও আত্দোন্নয়নের জন্য আর দানের প্রতিদান (মানুষের কাছ থেকে) পাওয়ার উদ্দেশ্যে সে দান করেনি, সে তো কেবল তার মহান মালিকের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে দান করেছে, আর অচিরেই সেও সন্তুষ্ট হবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (সুরা আল-লাইল ১৮ থেকে ২১ আয়াত)।

কাজেই আসুন, জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে সব কাজকর্মে, সমাজসেবা শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে আমরা ধর্মীয় বিষয়াদিকে অন্তর্ভুক্ত করি, ধর্মের কথা বলি, ধর্মের কাজ করি, নিজের কাজকর্মগুলোকে ধর্মের আলোকে সাজিয়ে নিই। আল্লাহর সাহায্য লাভের জন্য, আমাদের এ ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে।



আমাদের প্রত্যহিক জীবনে ধর্মীয় মূল্যবোধের অবস্থান

গণতান্ত্রিক সংবিধানকে কেটে-ছেঁটে, নিজেদের শাসনকে পাকাপোক্ত করার জন্য স্বৈরশাসকরা ধর্মকে একেকজন একেকভাবে ব্যবহার করতে থাকেন। বেহায়াপনা ও লাম্পট্যের জন্য ‘খ্যাতিমান’ ব্যক্তিকে আপনারা ভুলে যাননি নিশ্চয়। ধর্মকে সর্বাধিক অপব্যবহার করে এই ব্যক্তি ধর্মের প্রতি সবচেয়ে বেশি অবজ্ঞা দেখিয়েছেন। নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে তিনি আগেই সংবিধান লক্সঘন করেছেন। অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা, হা-হুতাশ করা অথবা একে অপরকে দোষ চাপানোর সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের সামনের দিকে তাকাতে হবে। অতীত এবং বর্তমান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে পারি। Prevention is better than cure- এ প্রবচনটি স্মরণযোগ্য। কোনো অপরাধ যাতে না ঘটে, প্রতিরোধ করাটাই হবে বাঞ্ছনীয়। বর্তমানে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, মৌলবাদ এগুলোর বিরুদ্ধে আমরা যেভাবে অগ্রসর হচ্ছি সেটা দীর্ঘমেয়াদি কোনো ফল বয়ে আনবে কিনা সন্দেহ আছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ার, মৌলবাদের বিরুদ্ধে ধরপাকড়, জেল-জুলুম-ফাঁসি অথবা সেই মতবাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, পাক-আফগান সীমান্তে বেসামরিক লোক অথবা তালেবান হত্যা সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে, সমস্যার সমাধান হবে না। কোনো আদর্শ বা মতবাদকে মহত্তর আদর্শ অথবা মতবাদ দিয়েই মোকাবিলা করতে হবে। হত্যাকাণ্ড দিয়ে হত্যাকাণ্ড রোধ করা যায় না, সন্ত্রাস দিয়ে সন্ত্রাস মোকাবিলা করা যায় না। তাহলে উপায় কি?


ধর্মীয় অপব্যাখ্যা

আত্মঘাতী হামলা কেন হয়, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ-মৌলবাদ কোন পরিস্থিতিতে বিস্তার লাভ করে, কেন করে এগুলোর কারণ খুঁজে দেখা দরকার। সমস্যার গোড়ায় যেতে হবে, ওপরের খোলস না দেখে ভেতরে কি আছে আমাদের সেটা জানার চেষ্টা করতে হবে। কর্মসংস্থানের অভাব, দারিদ্র্য, অশিক্ষা-কুশিক্ষা যেখানে আছে সে সব জায়গা ওই সব মতবাদের সূতিকাগার। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, গভীর জঙ্গল অথবা পর্বতগুহা, বস্তি অথবা উপাসনালয় যে সব জায়গায় এগুলো দীক্ষা দেওয়া হচ্ছে সেখানে রাষ্ট্রীয় যন্ত্র অথবা সৎ মানুষের সাহায্যের হাত পৌছতে হবে। যাদের রাষ্ট্র বিপদগামী বলে মনে করছে অথবা আমরা যাদের বিভ্রান্ত মনে করছি তাদের সঙ্গে অস্ত্রের ভাষায় কথা না বলে তাদের হৃদয় জয় করার চেষ্টা করতে হবে।


মানুষকে শৃঙ্খলাবোধ শেখায়

 

খোলা রাখতে হবে তাদের জন্য আলাপ-আলোচনার দ্বার। তারা যে বিভ্রান্ত এবং ভুল পথে রয়েছে, সেটা যুক্তি-তর্ক দিয়ে তাদের বোঝাতে হবে। দেখাতে হবে ধৈর্য, সহনশীলতা ও সহমর্মিতা। ধর্মীয় মূল্যবোধ দিয়ে ধর্মান্ধতা রোধ করতে হবে। Carrot and stick নীতি গ্রহণের কথা অনেকে বলেন। বর্তমানে আমরা শুধু stick ব্যবহার করছি, carrot মোটেই ব্যবহার করছি না। এই নীতি পাক-আফগান সীমান্তের জন্য যেমন প্রযোজ্য, বাংলাদেশ সরকারও সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ মোকাবিলায় এ নীতি গ্রহণ করতে পারে।আইন মানুষকে শৃঙ্খলাবোধ শেখায়, ধর্ম শেখায় নৈতিকতা। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আইনের শাসন এবং ব্যক্তি জীবনে ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা ব্যক্তি ও রাষ্ট্র সবার জন্যই মঙ্গলজনক।

 

ধর্মীয় মূল্যবোধের অপব্যবহার

পাকিস্তানের এই দ্বৈতসত্তার অস্তিত্ব আমরা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দেখতে পারি। জিন্নাহর মৃত্যুর পর রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র এবং বিলাতের সেভয় হোটেল ষড়যন্ত্র পেরিয়ে রাজনীতিবিদরা ১৯৫৬ সালে একটা শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সমর্থ হয়। ‘৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে সে শাসনতন্ত্রকে বিলুপ্ত করেন। কয়েক বছর পরে তিনি যখন একটি শাসনতন্ত্র পাকিস্তানবাসীকে উপহার দেন, তাতে ধর্মীয় লেবাস ছিল না। তার নিজের যখন রাজনীতি করার খায়েশ হলো জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য কিছু মতলববাজদের পরামর্শে তিনি সংবিধানে ইসলামিক শব্দটি যোগ করেন। তার এই কূটকৌশল পরবর্তী সব গণবিরোধী শাসক পাকিস্তানে গ্রহণ করেছেন। নিজেরা ধার্মিক না হয়ে ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করেছেন, জনগণকে ধোঁকা দিয়েছেন এবং পবিত্র ইসলামের নাম ব্যবহার করে যত সব অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড করেছেন। ইয়াহিয়া খানের নানা কেলেঙ্কারির কথা সবারই জানা আছে। এই মদ্যপ লম্পট শাসক নির্বাচন বানচালের জন্য প্রথমে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার জারি করেন, পরবর্তীতে পাকিস্তান ও ইসলামের নামে নিজ দেশের পূর্বাঞ্চলের মুসলমানদের উপর জঘন্য হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেন। ‘৭১ সালের এ পাপের বোঝা পাকিস্তান সারা জীবনই বয়ে বেড়াচ্ছে। খণ্ডিত পাকিস্তানের জন্মদাতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ‘৭১ সাল পরবর্তী নব্য পাকিস্তানের কাছে আরেক ধোঁকাবাজি নিয়ে হাজির হলেন। তিনি স্লোগান তুললেন ইসলামী সমাজতন্ত্রের। এ ব্যক্তিটিও ব্যারিস্টার, পাশ্চাত্যের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিপ্রাপ্ত। কিন্তু তার রাজনীতিতে আইনের শাসনও ছিল না, ছিল না ধর্মীয় মূল্যবোধের ছিটেফোঁটা।

 

ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারনা

সাধারণ মানুষের মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যে আঘাত হানে এমন কোন পদক্ষেপ নেবে না সরকার। তিনি আরো বলেছেন, শিক্ষানীতি নিয়ে বিভিন্ন অপপ্রচার চলছে। তবে শিক্ষামন্ত্রীর সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন বিভিন্ন ইসলামী দলের নেতৃবৃন্দ ও শিক্ষাবিদরা। তারা বলেছেন, সরকার যদি প্রকৃত পক্ষেই ইসলামের অনুকুলে শিক্ষানীতি চালু করতে চায়, তবে ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী শিক্ষাবিদদের দিয়ে নতুন করে শিক্ষানীতি তৈরি করতে হবে। অন্যদিকে জাতীয় শিক্ষক কর্মচারি ফ্রন্টের আহ্বায়ক অধ্যাপক কাজী ফারুক শিক্ষানীতি নিয়ে আজ জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক মতবিনিময় সভায় প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিগত সরকারগুলোর সময় ৭ বার শিক্ষানীতি প্রনয়ণ করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি বলেছেন, প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হলে দেশে আধুনিক বিজ্ঞান মনস্ক শিক্ষা ব্যবস্থার দ্বার উন্মোচিত হবে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা কমিশনের প্রধান অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া এই বিষয়ে রেডিও তেহরানকে বলেছেন, খুব তড়িঘড়ি করে শিক্ষানীতি তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, আড়াইমাসের মধ্যে শিক্ষানীতি তৈরি করে সরকার সস্তা জনপ্রিয়তা নেবার চেষ্টা করছে। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া বলেছেন, প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিতে অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত ধর্মীয় ও নীতি শিক্ষা নামে রাখা হলেও নবম দশম শ্রেণীতে তা বাদ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেছেন, আড়াই মাসের মধ্যে শিক্ষানীতির মত একটি বিষয় তৈরি করতে গেলে অনেক ধরণের ভুল ভ্রান্তি হওয়াটা স্বাভাবিক।

 

বিভিন্ন ধর্ম এর ব্যাপ্তি

বৌদ্ধ ধর্ম কিন্তু উত্তর ভারত হয়ে বাংলাদেশে এসেছে। সমাজের সাধারণ মানুষ যারা নিপিড়িত, নির্যাতিত এবং জাতিভেদ প্রথায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত ছিল তারা ব্যাপকভাবে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। আর বৌদ্ধ ধর্মটাই ব্রহ্মণ্য থেকে বিদ্রোহ করে আত্মপ্রকাশ করেছিল; ব্রাহ্মণ্য ধর্মের যারা অভিজাত শ্রেণী ছিল তাদের সাথে লড়াই করে বৌদ্ধ ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, বিকশিত হয়েছিল এবং টিকে ছিল।তবে শেষ পর্যন্ত ভারত বর্ষে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা টিকতে পারেনি আবার ব্রাহ্মন্যবাদীরা কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যে জিনিষটি দেখি সেটা হচ্ছে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম আর্যদের প্রভাবে প্রথম পর্যায়ে এখানে বিস্তার লাভ করেছে বটে কিন্তু খুব সুদৃঢ় রূপ লাভ করেনি।তারপরই বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক বিস্তারের ইতিহাস পাওয়া যায়। বাংলার ইতিহাস পালদের থেকে ধারাবাহিকভাবে পাওয়া যায় তার আগে খুব সামান্যই পাওয়া গেছে। বৌদ্ধদের মধ্যে যেহেতু জাতিভেদ কথাটা নেই ফলে যেসব বিষয় আপনি প্রশ্নে এনেছেন বা আমিও আলোচনার মধ্যে বলেছি সেসব বিষয় যে পালদের সময়ে ছিল তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। এসব বিষয় হয়তো আরো পরবর্তীতে ব্যাপ্তি লাভ করেছে।এগুলো ব্যাপ্তি লাভ করেছে সেন রাজাদের সময়ে কিম্বা আরো পরে শ্রী চৈতন্য দেব আত্মপ্রকাশ করে এসবের প্রচলন করেন এবং তিনি ব্যাপকভাবে ব্রহ্মণ্য ধর্মের সংস্কার করেন। তিনি জাতিভেদ তুলে দেন তাছাড়া পূজা পার্বণ এসবও তিনি তুলে দেন। এক হরিনাম সংকীর্তনকে গুরুত্ব দেন এবং জাতিভেদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তো এসবের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের স্থানীয় যে সংস্কৃতি ছিল বা সংস্কার ছিল তা বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে রূপলাভ করে। বৈষ্ণব ধর্ম তৎকালীন পটভূমিতে অনেক বেশী প্রগতিশীল ছিল এবং বৈষ্ণব ধর্ম তৎকালীন সময়ে ইসলামের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিল। শ্রী চৈতন্য ইসলাম এবং মুসলমানদের লক্ষ্য করেই হিন্দু ধর্মের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন।

 

ধর্ম নিরপেক্ষতা

অক্সফোর্ড ডিকশনারীর সংজ্ঞা মতে secular শব্দের অর্থ 1) not religious, sacred, or spiritual. 2) (of clergy) not subject to or bound by religious rule. বিশেষ্য হিসেবে এ শব্দটি Secularism রূপ ধারন করে। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে বোঝানো হয় কিছু নির্দিষ্ট প্রথা বা প্রতিষ্ঠানকে ধর্ম বা ধর্মীয় রীতিনীতির বাইরে থেকে পরিচালনা করা, যদিও বাস্তবে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ধর্মহীনতাকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিশেষ করে উপমহাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ মূলত ইসলাম ধর্মের দোষত্রুটি খুঁজে খুঁজে বের করে মানুষকে ইসলাম বিমুখ করার প্রচেষ্টাকেই বুঝায়। এ মতবাদ অনুযায়ী, “সরকার কোনরূপ ধর্মীয় হস্তক্ষেপ করবে না, কোন ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী হবে না এবং কোন ধর্মে কোন প্রকার অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করবে না” বলা হলেও সব সময়ই দেখা গেছে রাষ্ট্রীয়ভাবে এ মতবাদকে প্রচলন করার পাশাপাশি ব্যক্তিপর্যায়ে মানুষকে ইসলামী অনুশাসন পালনে অনুৎসাহিত করা হয়, কখনো কখনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়, ইসলামী অনুশাসন যারা মানতে চায় তাদেরকে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করে কোনঠাসা করে রাখা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও চাকুরী ক্ষেত্রে আইনী বাধার সৃষ্টি করা হয় এবং বিশেষ একটি ধর্মের অনুসারীদের আচার অনুষ্ঠানকে রাষ্ট্রীভাবে ও সামাজিকভাবে পূনর্বাসন করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালানো হয়। এরই অংশ হিসেবে আমরা দেখতে পাই পৌত্তলিক ধর্মের আচার অনুষ্ঠানকে সার্বজনীন উৎসবের নামে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচলন করা হয়। মূলত ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের অর্থ যাই থাক না কেন বাস্তবতা এই যে ধর্মহীনতা, নাস্তিকতা এবং সর্বোপরি ইসলাম বিরোধীতাই মূলত ধর্মনিরপেক্ষতার মূলমন্ত্র। তাই চিনির লেবেলযুক্ত প্যাকেট থেকে চিনি মুখে দিয়ে যদি লবনের স্বাদ পাই তবুও চটকদার লেবেলে বিভ্রান্ত হয়ে নুন দিয়ে পিঠে-পায়েশ বানানোর চেষ্টা চালালে তা চূড়ান্ত পাগলামীরই বহি:প্রকাশ হবে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মূলত পুঁজিবাদেরই বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং এর পাশাপাশি নারীমুক্তি আন্দোলন, নারী-স্বাধীনতা প্রভৃতি প্রগতিশীল শব্দ মূলত পুঁজিবাদের প্রসারেরই বিজ্ঞাপনমাত্র। তাই ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ প্রসাবের শুধু নাস্তিব্যবাদী ও ব্রাহ্মণ্যবাদীরাই সক্রিয় তা নয় বরং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের পালে জোরালো হাওয়া বইয়ে দিচ্ছে পাশ্চাত্যের পূঁজিপতি ও বহুজাতিক কোম্পানীগুলো। অনেকেই হয়তো ইসলামী বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হয় বলে উল্লেখ করতে পারেন, তবে একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন যে ইসলামী অনুষ্ঠানের নামে মূলত ইসলামের বিকৃত চেহারাকেই তুলে ধরা হয়। মূলত এসব অনুষ্ঠানাদি ধর্মব্যবসায়ী কিছু অসাধু মুসলমানকেই প্রশ্রয় দেয় যারা মূলত ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদেরই ভিন্ন চেহারায় আবির্ভূত হয়।

ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাবে যা হচ্ছে

ইভটিজিং, নারী নির্যাতন, পরকীয়া এসব সামাজিক ব্যাধি প্রচলিত পাশ্চাত্য ঔষধে নিরাময়যোগ্য নয়, বরং এ ব্যধি রোধে বিষবৃক্ষের মূলোচ্ছেদ করা জরুরী। আর ইসলামী অনুশাসন এক্ষেত্রে সর্বোত্তম বিবেচিত। ইসলামী অনুশাসন সমাজে এখনো প্রচলিত আছে বলেই আমরা শুকরের মাংশ মুখে তুলি না, খাবারের ক্ষেত্রে হালাল-হারাম বেছে চলি, তবে যারা ইসলামী অনুশাসনকে প্রত্যাখ্যান করেছেন তাদের অনেকেই হারাম বস্তুকে হালাল করে নিয়েছেন, তাদের কাছে খাদ্য খাদ্যই, শুকর আর ছাগল উভয়েই মাংশের যোগান দেয়, তাই এদের মাঝে ভেদাভেদ করার যৌক্তিকতা নেই, তবে যদি এলার্জির বিষয় থাকে তো আলাদা। ঠিক তেমনি আমরা সমাজে বিয়ে তথা যৌনাচারের ক্ষেত্রে কিছু অনুশাসন মেনে চলি। ইসলাম মা, খালা, বোনসহ কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনের সাথে বিয়ে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে কোন সুস্পষ্ট বিধিনিষেধ নেই, বরং গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অধিকাংশ যদি ইসলাম কর্তৃক নিষিদ্ধ নারীদের বিয়ে করা  বৈধ বলে ভোট দেয় তো তাও চালু হয়ে যাবে। ইসলাম যেখানে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে, ধর্মীয় অনুশাসন, হালাল-হারাম কে যদি তোয়াক্কাই না করি তবে কারো সাথে যৌনাচারই অবৈধ হওয়ার কথা নয়, যেহেতু বিষয়টি শুধুই শারীরবৃত্তীয়, তাই কার সাথে তা সম্পাদিত হচ্ছে, তা মূখ্য নয়, ধর্মহীন মতবাদে উভয়ের সম্মতিই চুড়ান্ত বিবেচ্য বিষয়। A profile of Canada’s shelters for abused women শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় যে ১৮ বছরের নীচের শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার সন্তানদের প্রতি ১০ জনের ৩ জন নিজ পরিবারের সদস্যদের দ্বারাই নির্যাতিত হয় যাদের আবার ১০ জনের ৬ জনই বাবার হাতে নিগৃহীত। এ হলো আধুনিক সমাজের প্রতিচ্ছবি। এক্ষেত্রে মিশরীয় সভ্যতাও একটি উদাহরণ হতে পারে। মিশরীয় রাজকুমারীরা তাদের ভাইদেরকেই বিয়ে করতো। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী বলে খ্যাত ক্লিওপেট্রা তার ভাইদের বিয়ে করেন পরে ভাইকে হত্যা করে অন্য প্রেমিককে বিয়ে করেন। যেহেতু রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব রাজকন্যাদের পাপ্য নয় তাই ভাইকে বিয়ে করে ক্ষমতার ভাগীদার হন তিনি, পরে ভাইকে হত্যা করে নিরংকুশ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এ সমাজে নৈতিকতা মূখ্য কোন বিষয় ছিল না বরং ক্ষমতা ও অবাধ যৌনাচারই ছিল মূখ্য বিষয়। আমরা যদি ধর্মীয় অনুশাসনকে ছুড়ে ফেলে দেই তবে মিশরীয় সভ্যতায় ফিরে যাওয়া অসম্ভব নয়, কারণ ওটাকে আমরা সভ্যতা বলেই স্বীকৃতি দিচ্ছি, আর মুসলিম শাসনকে বলছি মধ্যযুগীয় বর্বরতা

 

শাসকগোষ্ঠীর নিজেদের স্বেচ্ছাচারী

প্রতিষ্ঠিত সরকার কর্তৃক সব শ্রেণী-পেশার নাগরিক ও অধিবাসীদের মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার সুরক্ষার কার্যকর ব্যবস্থাকে আইনের শাসন বলা হয়। সংক্ষেপে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের যথাযথ ব্যবস্থাকে আইনের শাসন বলা হয়। পৃথিবীতে আইন প্রধানত দুই প্রকার- যথা আল্লাহ প্রদত্ত আইন ও মানব রচিত আইন। স্রষ্টাকর্তৃক প্রদত্ত আইন পৃথিবীর সব দেশেই একইরূপে বিরাজিত। ভিন্নরূপ দেখা দিলে মনে করতে হবে আইনের কোনো অংশে ভেজাল মিশ্রিত করা হয়েছে। পক্ষান্তরে মানব রচিত আইনের কোনো সুনির্দিষ্ট মানদন্ড নেই। কেননা বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রকারের শাসকগোষ্ঠী নিজেদের স্বেচ্ছাচারী কার্যক্রম বাস্তবায়নে, চিরদিন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার প্রয়োজনে, অপরের অধিকার হরণে ও সম্পদ লুণ্ঠনে এসব আইন প্রণয়ন করে, সংশোধন, পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে। এজন্যই দেখা যায়, রাজতান্ত্রিক শাসনতান্ত্রিক আইনে গণদাবি উত্থাপনের জন্য দল গঠন বেআইনী, সমাজতান্ত্রিক দেশে ধনতান্ত্রিক কর্মকান্ড বেআইনী, সামরিক শাসনে গণতান্ত্রিক দল ও কার্যকলাপ বেআইনী, সাম্রাজ্যবাদের পুতুল সরকারের নিকট দেশপ্রেমিক জনগণের কার্যক্রম বেআইনী, বর্ণবাদী শাসনে সমানাধিকারের ধারণা বেআইনী, স্বেচ্ছাচারী ও স্বৈরাচারী শাসকের দৃষ্টিতে মৌলিক মানবাধিকারের দাবিতে বেআইনী ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।

 

সর্বসম্মত ও স্থায়ী কোনো নীতি-নির্ধারণ

ধর্মকে বাদ দিয়ে মানুষ এখনো পর্যন্ত তাদের জীবনযাত্রার সর্বসম্মত ও স্থায়ী কোনো নীতি-নির্ধারণ করতে পারেনি। আইন বিশেষজ্ঞরা এখনো সেই সঠিক ভিত্তির সন্ধান পাননি যার ওপর ভিত্তি করে আইন রচনা করবেন। অধ্যাপক পেটন লিখেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আমরা শুধুমাত্র ধর্মের মধ্যেই এমন একটি ভিত্তি খুঁজে পেতে পারি। কিন্তু ধর্মের সত্যতা যুক্তির মাধ্যমে নয় বরং, আকীদা বিশ্বাসের মাধ্যমেই গ্রহণ করা হয়। এরপর তিনি প্রশ্ন করেছেন, সত্যিকারভাবে কোনো আদর্শ মূল্যমান আছে কি, যা আইনের ক্রমোন্নতিতে তাকে পথ প্রদর্শন করবে? এ ধরনের মূল্যমান যদিও এখনো পর্যন্ত উদ্ভাবিত হয়নি, কিন্তু তা কানুনের জন্য একান্ত অপরিহার্য। তবে এক্ষেত্রে অসুবিধা এই যে, ধর্মকে উপেক্ষা করলে মুল্যমান নির্ণয়ের আর কোনো পথ থাকে না।’ আইনের ইতিহাসের প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ স্যার হেনরি মান লিখেছেন, ‘সুষ্ঠুভাবে লিখিত এমন কোনো আইন ব্যবস্থা চীন থেকে পেরু পর্যন্ত কোথাও পাওয়া যাবে না, যা তার সূচনাকাল থেকেই ধর্মীয় বিধিব্যবস্থা ও উপাসনা রীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।’ এ প্রসঙ্গে ড. ক্রাউডম্যান লিখেন, ‘ন্যায়বিচারের সত্যিকার মাপকাঠি নির্ধারণের জন্য ধর্মের দিক-নির্দেশনা ছাড়া অন্যকিছু পাওয়া যাবে না। আর ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্তমূলক ধারণাকে বাস্তব রূপ দেয়ার জন্য ধর্ম প্রদত্ত ভিত্তিই হচ্ছে সবচাইতে স্বাভাবিক ও অকৃত্রিম ভিত্তি।’ আইনের সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, আইন কে প্রণয়ন করবেন এবং কে তিনি, যার অনুমোদনে একটি আইন আইনের মর্যাদা পাবে? আইন বিশেষজ্ঞরা আজ পর্যন্ত এ সমস্যার বাস্তব কোনো সমাধান বের করতে সক্ষম হননি। ধর্ম এর উত্তর এই প্রদান করে যে, আইনের উৎস হচ্ছেন তিনি, যিনি মানুষসহ বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন ও পরিচালনা করছেন। বিশ্বজগত যেহেতু তাঁর পরিচালনায় সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হচ্ছে সেহেতু মানুষ ও তাঁর প্রদত্ত বিধানের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে সক্ষম হবে। বিশ্বনিয়ন্তাই মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আইন রচনার একমাত্র অধিকারী, মানুষ একাধারে আইন প্রণয়ন ও শাসক হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। এই অধিকার শুধুমাত্র তাঁরই প্রাপ্য যিনি সমগ্র মানুষের সৃষ্টিকর্তা এবং কার্যত তাদের প্রকৃতিগত শাসক। মানব রচিত আইনে বিচার করা যায় তবে সে বিচার ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও নৈতিকতার মানদন্ডে উত্তীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

 

ইসলাম ধর্মীয় মূল্যবোধ

মানবসমাজকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য আইনের প্রয়োজন, আইনের সঠিকতার জন্য মূল্যবোধের প্রয়োজন, মূল্যবোধের সঠিকত্বের জন্য ধর্মের প্রয়োজন, সৃষ্টিকর্তার অনুমোদন প্রয়োজন। ধর্ম ব্যতীত, ধর্মীয় অনুশাসন ব্যতীত, ধর্মীয় মূল্যবোধ ব্যতীত অপর কোনো শক্তি, মতবাদ বা আইন মানুষকে সঠিক পথে, শাশ্বত কল্যাণের পথে পরিচালিত করতে সক্ষম নয়। কেননা, ধর্ম শুধু আইনই দেয় না, বরং সেই সঙ্গে এই ধারণাও দেয় যে, যিনি এই আইন আরোপ করেছেন তিনি মানুষের সারা জীবনের খবর রাখেন। মানুষের নিয়ত ও সংকল্প, মানুষের গোপন ও প্রকাশ্য কার্যকলাপ তার সবিস্তার জানা রয়েছে। মৃত্যুর পর মানুষকে তার সামনে হাজির করা হবে এবং পাপ-পুণ্যের শাস্তি ও পুরস্কার প্রদান করা হবে। ধর্মীয় মূল্যবোধের ধারক ও বাহক শাসক কর্তৃক আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়কে দমনে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হলো- জাজিরাতুল আরব, সিরিয়া, পারস্য ও মিসরের শাসক, ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমরের (রাঃ) শাসনকালে তার এক পুত্রকে ব্যভিচারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। আইন মোতাবেক অপরাধীর সাজা সাব্যস্ত হয় একশত দোররা বা বেত্রাঘাত। মহান খলিফা চিন্তা করলেন, অপর কাউকে এ বেত্রাঘাতের দায়িত্ব প্রদান করলে সে হয়তো খলিফার পুত্র হিসেবে হালকাভাবে বেত্রাঘাত প্রদান করবে, ফলে আইনের শাসন ন্যায়বিচার ও ধর্মীয় মূল্যবোধ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমতাবস্থায় খলিফা স্বয়ং বেত্রাঘাতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১০০ দোররা মারা শেষ হওয়ার পূর্বেই খালিফা পুত্র মৃত্যুবরণ করে। মৃত্যুর পর তাকে যথাযথভাবে কবরস্থ করা হয় এবং কবরের ওপর অবশিষ্ট বেত্রাঘাত করা হয়।

 

হিন্দু ধর্মীয় মূল্যবোধ

হিন্দুধর্ম এমনই একটি মূলধারার ধর্মবিশ্বাস যা একটি সুবিস্তৃত ভৌগোলিক ক্ষেত্রে এক বহুধাবিভক্ত জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্যে দিয়ে বিকাশলাভ করেছে। এই বিকাশলাভ সম্ভবপর হয়েছে মূলত দুটি পন্থায়: হিন্দুধর্মের পুরনো রীতিনীতির নবীকরণ এবং বহিরাগত রীতিনীতি ও সংস্কৃতি থেকে আত্মীকরণ। এর ফলে ধর্মীয় ক্ষেত্রে এক বিরাট বৈচিত্র্যময় সমাবেশ গড়ে উঠেছে। এই সমাবেশে যেমন স্থান পেয়েছে অসংখ্য ছোটো ছোটো আদিম ধর্মমত, তেমনই স্থান পেয়েছে সমগ্র উপমহাদেশে লক্ষাধিক মতাবলম্বী সমন্বিত প্রধান ধর্মসম্প্রদায়গুলিও। বৌদ্ধধর্ম বা জৈনধর্মের থেকে পৃথক ধর্মবিশ্বাসরূপে হিন্দুধর্মের পরিচিতিও তাই এই মতাবলম্বীদের অনুমোদনসাপেক্ষ বিষয়। হিন্দুধর্মে দৈব ব্যক্তিত্বদের দেব (স্ত্রীলিঙ্গে দেবী) নামে অভিহিত করা হয়। বাংলায় দেবতা শব্দটি দেব শব্দের সমার্থক শব্দরূপে বহুল প্রচলিত। শব্দটির আক্ষরিক দৈব সত্ত্বা। আবার ইংরেজি ভাষায় শব্দটি গড শব্দের সমার্থক। হিন্দু সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলেন হিন্দু দেবগণ। চিত্রকলা ও স্থাপত্যে মূর্তির আকারে এবং বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থে, বিশেষত ভারতীয় মহাকাব্য ও পুরাণে নানান উপাখ্যানে তাঁদের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঈশ্বরের থেকে এঁরা পৃথক। অনেক হিন্দুই তাঁদের ইষ্টদেবতার রূপে ঈশ্বরকে পূজা করে থাকেন।ইষ্টদেবতার নির্বাচন ব্যক্তিগত, আঞ্চলিক বা পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে হয়ে থাকে।


নিরীশ্বরবাদীদের মূল্যবোধ

ইংরেজি ‘এইথিজম’(Atheism) শব্দের অর্থ হল নাস্তিকক্য বা নিরীশ্বরবাদ। এইথিজম শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক ‘এথোস’ (ἄθεος) শব্দটি থেকে। শব্দটি সেই সকল মানুষকে নির্দেশ করে যারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই বলে মনে করে এবং প্রচলিত ধর্মগুলোর প্রতি অন্ধবিশ্বাস কে যুক্তি দ্বারা ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করে। দিনদিন মুক্ত চিন্তা, সংশয়বাদী চিন্তাধারা এবং ধর্মসমূহের সমালোচনা বৃদ্ধির সাথে সাথে নাস্তিক্যবাদেরও প্রসার ঘটছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম কিছু মানুষ নিজেদের নাস্তিক বলে স্বীকৃতি দেয়। বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যার ২.৩% দেরমানুষ নিজে নাস্তিক বলে পরিচয় দেয় এবং ১১.৯% মানুষ কোন ধর্মেই বিশ্বাস করে না।জপানের ৬৪ থকে % নাস্তিক অথবা ধর্মে অবিশ্বাসী। রাশিয়াতে এই সংখ্যা প্রায় ৪৮ এবং ইউরোপিয় ইউনিয়নে ৬%ইতালী) থেকে শুরু করে ৮৫% (সুইডেন) পর্যন্ত। পশ্চিমের দেশগুলোতে নাস্তিকদের সাধারণ ভাবে ধর্মহীন বা পরলৌকিক বিষয় সমূহে অবিশ্বাসী হিসেবে গন্য করা হয়।  কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের মত যেসব ধর্মে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হয় না, সেসব ধর্মালম্বীদেরকেও নাস্তিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিছু নাস্তিক ব্যক্তিগত ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা, হিন্দু ধর্মের দর্শন, যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ এবং প্রকৃতিবাদে বিশ্বাস করে। নাস্তিকরা কোন বিশেষ মতাদর্শের অনুসারী নয় এবং তারা সকলে বিশেষ কোন আচার অনুষ্ঠানও পালন করে না। অর্থাৎ ব্যক্তিগত ভাবে যে কেউ, যে কোন মতাদর্শে সমর্থক হতে পারে,নাস্তিকদের মিল শুধুমাত্র এক জায়গাতেই, আর তা হল ঈশ্বরের অস্তিত্ব কে অবিশ্বাস করা। ভিক্টর স্টেংগার এই ব্যক্তিদেরকেই নব-নাস্তিক্যবাদের প্রধান লেখক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। উল্লেখ্য, নব-নাস্তিকেরা ধর্মের সরাসরি বিরোধিতা করেন। তারা ধর্মকে প্রমাণবিহীন বিশ্বাস বলে আখ্যায়িত করেন এবং এ ধরণের বিশ্বাসকে সমাজে যে ধরণের মর্যাদা দেয়া হয় সেটার কঠোর বিরোধিতা করেন।


খ্রীষ্টান ধর্মীয় মূল্যবোধ

একজন প্রকৃত খ্রিষ্টান হলেন তিনিই যিনি যিশুখ্রিষ্টের ব্যক্তিত্বের কাছে তার বিশ্বাস এবং নির্ভরতা অর্পণ করেন এবং ঘটনাটা হল যে তিনি আমাদের পাপের জন্য ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন এবং মৃত্যুকে জয় করার জন্যে এবং যারা তাঁকে বিশ্বাস করে তাদেরকে তিনি শাশ্বত জীবন দান করতে তিনদিন পরে পুনরায় জেগে উঠেছিলেন । জন 1:12 আমাদের বলে: “কিস্তু যত বেশি লোকে তাঁকে গ্রহণ করবে, তত বেশি লোককে তিনি ঈশ্বরের সন্তানের অধিকার দেবেন”। একজন সত্যিকারের খ্রিষ্টান প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরেই সন্তান, ঈশ্বরের সত্যিকারের পরিবারের একজন সদস্য, এবং যাকে খ্রিষ্টের মধ্যে এক নতুন জীবন দান করা হয়েছে। একজন সত্যিকারের খ্রিষ্টানের চিহ্ণ হল অপরের প্রতি প্রেম এবং ঈশ্বরের কথার প্রতি বাধ্যতা (1 জন 2:4; 1 জন 2:10)। যে কারণে আপনি এটি পড়লেন তার ওপর আপনি কি খ্রিষ্টধর্মের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন? যদি তাই হয়, তাহলে অনুগ্রহ করে নিচের বাটনে “আমি আজ খ্রিষ্টধর্মকে গ্রহণ করেছি” এর ওপর ক্লিক করুন।


অসুস্থ চিন্তাভাবনা

মহাবিশ্ব সৃষ্টির একচ্ছত্র পরিকল্পনাকারী ও নিরঙ্কুশ অধিপতি আল্লাহতায়ালা মানুষকে কেন্দ্র করেই সব বিধিবিধান জারি করেছেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআন হলো বিশ্বমানবতার জন্য জীবনযাপনের সামগ্রিক সমস্যার উৎকৃষ্ট সমাধান। এটি আল্লাহ প্রেরিত অনুপম ঐশী সংবিধান। আল কুরআনের লক্ষ্যবস্তু মানুষ। পবিত্র কুরআনের বহুমুখী নির্দেশনার প্রতিটি স্তরে গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদায় মানুষের আনাগোনা। ইসলাম মানুষের স্বাভাবিক জীবনঘনিষ্ঠ নিয়ম-কানুনেরই সমন্বিত ও ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালা। ইসলাম ভারসাম্যপূর্ণ, দরদি ও প্রশান্তচিত্ত মানবিক মূল্যবোধের একনিষ্ঠ উদগাতা। বিকৃত ও বিভ্রান্ত বিচারবোধের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে ইসলাম কখনো কখনো একটি নির্দয় প্রতিক্রিয়াশীল ধর্ম হিসেবে আখ্যা পায়, যা অতি মাত্রায় দুঃখজনক ও অক্ষমার্হ। শয়তান প্ররোচিত অসুস্থ চিন্তাভাবনার মোহ কাটাতে না পেরে জঘন্য অপব্যাখ্যায় অনেকেই আত্মনিয়োগ করেন। আমরা দেখছি বর্তমান বিশ্বে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত অপচেষ্টা সমাজের মূল্যবোধ ক্রমাগতভাবে শুধু বিনষ্ট করেই চলেছে। ফলে হিংসা-হানাহানি ও সঙ্ঘাতের কবলে পড়ে বিশ্বসমাজকে অনেক মূল্য দিতে হচ্ছে।


মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দূরে

প্রতিবেশীর হকের ব্যাপারে ইসলামে যে বিধান বা নির্দেশনা এসেছে তা চমৎকার মানবিক মূল্যবোধের পরিচায়ক। এ ক্ষেত্রে ধর্ম, বর্ণ বা কোনো রকম সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিন্দুমাত্র অবকাশ চিহ্নিত করা হয়নি। প্রতিবেশী যে ধর্মের, যে আদর্শের কিংবা যে সম্প্রদায়েরই হোক না কেন তার প্রতি সুবিচার করা ও সদয় হওয়া মুসলমানের নৈতিক কর্তব্য। ইসলামের উদার মানবিক মূল্যবোধের শাণিত প্রমাণ পাওয়া যায় এখানে। ট্রেনের ওই যাত্রী যিনি ধর্মনিরপেক্ষতার ধারক, তিনি ইসলামের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হয়তো দূরে, আদর্শিক মানের বিচারে তার অবস্থান অনেক নিচে, কিন্তু মানুষ হিসেবে তিনি একটি অভিন্ন মর্যাদার অধিকারী। ইসলাম যেকোনো মানুষের এ মর্যাদা ও অধিকারকে সম্মান করে। সাদা-কালো বর্ণের ভেদ বিচার ইসলাম কখনই করতে জানে না। ব্যক্তি দেখতে সুন্দর নয় বলে তার সাথে কথা বলতে অনীহা প্রকাশ ইসলামসম্মত নয়। অনেকেই ইসলামকে কট্টর পন্থা হিসেবে অপবাদ আরোপের চেষ্টা চালান। বাস্তবিক পক্ষে এ অপবাদ নিরেট মিথ্যাচার অথবা প্রতিহিংসামূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। ইসলামি অনুশাসনকে যারা মনেপ্রাণে ভালোবাসেন এবং মেনে চলেন তাদেরও এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা প্রয়োজন। মুসলমানদের একটু ত্রুটিকে ইসলামবিদ্বেষী চক্র বিরাট আকারের পরিণতিতে পর্যবসিত করতে পারে। তখন এর দায়ভার গিয়ে পতিত হয় ইসলামের ওপর। বিশ্বব্যাপী ইসলামকে ভুল বোঝাবুঝির মাত্রা এতই বেড়ে চলেছে যে, এটি একটি উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

পবিত্র কুরআনের সূরা আল ইমরানের ১১০ নম্বর আয়াতে মানব জাতিকে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি! তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য।’ সৃষ্টি হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বই মানুষের মূল্যবোধের উপযুক্ত মাপকাঠি। সৃষ্টি কর্তার পক্ষ থেকে এটা দ্ব্যর্থহীন স্বীকৃতি যে, বিশ্ব চরাচরের কোটি কোটি সৃষ্টির মধ্যে মানুষই সবার সেরা। সুতরাং প্রত্যেক মানুষ আরেকজন মানুষের কাছ থেকে মর্যাদা পাওয়ার নিশ্চিত দাবিদার। ইসলাম আদম জাতির মানবিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকায় অবতীর্ণ। জীবনের নানাবিধ ক্ষেত্রে মানুষকে যথার্থ মূল্য দেয়া ইসলামের নৈতিক শিক্ষারই অংশবিশেষ। চলতে-ফিরতে, হাটবাজার কিংবা অফিস-আদালতে কারো সাথে এমন কোনো আচরণ করা ইসলাম পছন্দ করে না, যাতে অপর ব্যক্তির আত্মমর্যাদায় হানি ঘটে। শুধু আপনাকে নিয়েই মানুষের সব চিন্তা আবর্তিত হলে চলে না। সমাজবদ্ধ জীবনে মানুষের অপরাপর অধিকারের কথাও গুরুত্বের সাথে ভাবতে হয়। মানুষের সাথে অশোভন আচরণের কোনোরূপ অবকাশ ইসলাম তার অনুসারীদের দেয়নি। দল-মত নির্বিশেষে সমাজের সব স্তরের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ক্ষেত্রে মানবিক মূল্যবোধ একটি অপরিহার্য চাবিকাঠি। বলতে দ্বিধা নেই, সমাজে মানবিক মূল্যবোধের সঙ্কটে নানা রকম বিপর্যয় ও অশান্তির দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে।


দৈনন্দিন জীবনে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি

সহিষ্ণুতা মানুষের একটি অতি প্রয়োজনীয় গুণ। কিন্তু মূল্যবোধের অবক্ষয় মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতার পরিমাণ ক্রমাগতভাবে কমিয়ে দেয়। দুনিয়াতে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের যত ঘটনা ঘটে তার অধিকাংশই ঘটে থাকে সহিষ্ণুতার অভাবে। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা আদর্শের মানুষের সাথে চলতে হয়, লেন-দেন করতে হয়। কখনো কোনো কাজের জন্য লাইন ধরে দাঁড়ানোর প্রয়োজন পড়ে। বলা বাহুল্য, এ ধরনের ক্ষেত্রে অসৌজন্যমূলক ও অপ্রীতিকর ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। ইসলাম এটাকে সমর্থন করে না। অপরের অধিকার ও মর্যাদাদানের ব্যাপারে ইসলাম অত্যন্ত যত্নবান। আমাদের প্রিয় নবী সঃ একজন অমুসলিম মেহমানের সাথে কিরূপ আচরণ করেছিলেন আমরা জানি। বিশ্বমানবতার পথ প্রদর্শক রাসূল সঃ ঐতিহাসিক সে ঘটনার মাধ্যমে গোটা বিশ্ববাসীর জন্য যে আলোকিত শিক্ষা উপহার দিলেন তার মূল্য কি আমরা পরিমাপের চেষ্টা করি?

ইসলামে মানবিক মূল্যবোধের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবনের সময় এসেছে। ইসলামের নামে যেখানে এত দল বিভক্তি, এত আহ্বান, আবার ইসলামের বিরুদ্ধে যেখানে এত বিষোদগার আর এত আক্রমণ সেখানে মুমিনের অধিক সচেতন ও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। ইসলামি অনুশাসনের নিয়ম-নীতির পাশাপাশি এর মহত্তম কল্যাণবোধের দিকটি দক্ষ কুশলতায় ফুটিয়ে তোলা দরকার। মানুষের কাছেই মানুষের অনিরাপত্তা ও ভয়ঙ্কর শত্রুতা ভরা পৃথিবীতে ইসলামের কল্যাণময় ঔদার্য বিপুল জনগোষ্ঠীর নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান দিতে পারে।

 

হিসাব করে এবং লোক দেখানো ইবাদত করা:

মুস্তাহাব (প্রশংসনীয়) কাজগুলো না করলে শাস্তি নেই, কিন্তু করলে পুরস্কার আছে। আবার এমন বিষয় আছে যা রাসূলুল্লাহ সাঃ সর্বদা করেছেন, পরিহার করেননি; কিন্তু অন্যকে করার জন্য সুস্পষ্ট আদেশ দেননি। এগুলো যে বাধ্যতামূলক নয় তা প্রমাণ করার জন্য সাহাবায়ে কিরাম এসব কাজের কিছু কিছু করেননি। মাজহাবগুলোর মত অনুযায়ী মুস্তাহাবের আদেশ আছে; কিন্তু সুস্পষ্টভাবে নয়। ফরজ দ্ব্যর্থহীনভাবে বাধ্যতামূলক, করলে সওয়াব, উপেক্ষা করলে গুনাহ। আর পালন না করলে ফিস্‌ক, পাপকাজ। আর বিশ্বাস না করলে কুফরি। ফরজ দু’ভাগে বিভক্ত। ফরজে কিফায়াহ (সামষ্টিক কর্তব্য) ও ফরজে আইন (ব্যক্তিগত কর্তব্য)। ব্যক্তিগত কর্তব্য প্রত্যেক মুসলমানকে পালন করতে হবে। আর সামষ্টিক কর্তব্য কেউ করলেই চলবে, অন্যরা না করলে গুনাহ নেই। ব্যক্তিগত কর্তব্যের শ্রেণী বিভাগ আছে। এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ফারাইজ যা ঈমানের মৌলিক অঙ্গ, যেমন শাহাদাহ অর্থাৎ সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাঃ তাঁর রাসূল এবং কর্মে প্রতিফলন হচ্ছে সালাত, জাকাত, সিয়াম ও হজের মাধ্যমে। আরো কম গুরুত্বপূর্ণ ফারাইজ আছে, কিন্তু এগুলোও বাধ্যতামূলক। ফরজে কিফায়ার চেয়ে ফরজে আইনের গুরুত্ব অধিক। পিতার প্রতি সদাচার ফরজে আইন যা জিহাদের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ, জিহাদ ফরজে কিফায়াহ। পিতার অনুমতি ছাড়া পুত্র জিহাদে অংশ নিতে পারবে না। এ সম্পর্কে প্রামাণিক হাদিস আছে। আবার ব্যক্তিগত অধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট ফরজে আইনের ওপর সামাজিক অধিকারের সাথে সম্পৃক্ত ফরজে কিফায়াহ অগ্রাধিকার পাবে। মুসলিম ভূখণ্ড আক্রান্ত হলে জিহাদ ফরজে আইন। তখন পিতার অধিকার গৌণ হয়ে যায়। এমনিভাবে ওয়াজিবের ওপর ফরজ, সুন্নাতের ওপর ওয়াজিব ও মুস্তাহাবের ওপর সুন্নাতের অগ্রাধিকার রয়েছে। একইভাবে ইসলাম ব্যক্তিগত আত্মীয়তার ওপর সমাজিক দায়িত্ব এবং এক ব্যক্তির জন্য উপকারী কাজের ওপর একাধিক ব্যক্তির উপকার হতে পারে এমন কাজে অগ্রাধিকার দেয়। এ জন্য ইসলাম ব্যক্তিগত ইবাদতের চেয়ে জিহাদ ও ফিকাহের প্রতিবেশী গুরুত্ব দেয়। নফল ইবাদত, দান-খয়রাতের চেয়ে দু’পক্ষের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসার প্রতিও ইসলাম অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।


বাংলাদেশে ধর্মীয় মূল্যবোধের শিকড় সহস্র বছর ধরে প্রোথিত

দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নতুন হলেও জনগণের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি বহু পুরনো। প্রায় সহস্র বছর ধরেই তারা স্থানীয় বাঙালি মূল্যবোধের উপর জয়ী হয়ে এসেছে। এটা নিতান্তই সহজাত যে কোন শক্তিশালী ও প্রগাঢ় মূল্যবোধ ঐতিহাসিক পরিক্রমনের মধ্য দিয়ে অপেক্ষাকৃত দূর্বল মূল্যবোধকে পরাস্ত করে যা প্রতিটি মানব সমাজেরই বাস্তবতা এবং বাংলাদেশের মাটিতেও একই বাস্তবতার পুনরাবির্ভাব ঘটেছে। বাংলাদেশ অঞ্চলে মুসলমানদের আগমনের পূর্বে স্থানীয় মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি কেবল অতি প্রাচীনই ছিলনা; তা ছিল মানুষের সকল রিপুর দ্বারা সংক্রমিত। সামন্ত প্রভূদের শোষণ ছিল সে সব কথিত মূল্যবোধের ভিত্তি। সাধারণ মানুষের কোন অর্থনৈতিক বুনিয়াদ ছিলনা; এমনকি মানুষ হিসেবে তাদের অধিকারের কোন মানদন্ড ছিলনা। তবে এতদঞ্চলে মুসলমানদের আগমনের পর- যা হয়তো পীর-আওলিয়া-সুফিরা শুরু করেছিল অষ্টম শতকের শুরুতে কিংবা তের শতাব্দীতে বিজয়ী বীর ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজীর আমল শুরুর পর থেকে যে মূল্যবোধ, পদ্ধতি, মানবিক গুণাবলী চালু হয়, তার মধ্যেই মানবিকতার সঠিক দিক-নির্দেশ প্রতিফলিত হয়। তবে মূল্যবোধের সে মানবিক রূপ পরিগ্রহ করা কুসুমাস্তীর্ণ ছিলনা। মূল্যবোধকে মানবিক রূপ পরিগ্রহ করতে হয়েছিল স্থানীয় মূল্যবোধের কায়েমী স্বার্থের পক্ষ থেকে সংগঠিত নানাবিধ প্রতিরোধ ও বহু সংগ্রামকে মোকাবেলা করার মধ্য দিয়ে; যে কায়েমী স্বার্থের উৎস ছিল হিন্দুত্ববাদ -যা ছিল মানুষের সমানাধিকার জীবন ধারণের স্বাধীনতা ও সম্পদ এর উপর সমান অধিকার এবং সকল নাগরিকের সমান স্বাধীনতার পরিপন্থী। স্থানীয় বাঙালি মূল্যবোধ ছিল হীনমন্যতা-উচ্চমন্যতাবোধ ও খাটি-দূষণে দোলায়িত; যার ফলে পুরুষ ও মহিলার মধ্যে উচ্চ ও নিম্নবর্ণের শ্রেণীভেদ প্রথা চালু করা হয়। হিন্দু বিশ্বাস মতের বর্ণভেদ প্রথা মানুষের সকল ধরণের মর্যাদা বিরোধী, যদিও বর্ণভেদী সেই সমাজ একই এলাকায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রতিবেশী হিসেবে বসবাস করে আসছে। বাংলাদেশের মাটিতে ইসলামের আগমন ও প্রতিষ্ঠা বাইরে থেকে আসা হলেও সামাজিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ভিন্নতরভাবে রূপ পরিগ্রহ করে। এটা সত্যি যে সবকিছু দ্রুত বা একরাতের ব্যবধানে পরিবর্তিত হয়নি। তবে ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত মূল্যবোধের শক্তি এমনি যে এটা অনেক কিছুরই পরিবর্তন অতি দ্রুত তথা রাতারাতি কিংবা বলা যায় এক রাতের ব্যবধানেই ঘটিয়ে ফেলে। স্থানীয় অমুসলিম শাসকরা নতুন মূল্যবোধকে প্রতিরোধ করার সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করা সত্ত্বেও ইসলামিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির ঢেউ তাদের সব প্রতিরোধকে গুড়িয়ে দেয়। যার দরুণ ষোল শতাব্দীতে মোগল রাজত্বের মাঝামাঝি সময়তেই সারা ভারতীয় উপমহাদেশ মুসলিম মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির সর্বোচ্চ প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে পড়ে। স্থানীয় পর্যায়ের কিছু কিছু সংস্কৃতির অস্তিত্ব থাকলেও তা প্রভাব সৃষ্টি করার সকল ক্ষমতা হারিয়ে ইসলামী মূল্যবোধের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের আওতায় আসে। এই সংস্কৃতি খাদ্যাভাস ও পোষাক-পরিচ্ছদ থেকে স্বাস্থ্যসম্মত বাসগৃহ নির্মাণ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।


বিশ্বায়নে ধর্মীয় মূল্যবোধ

আজকের বিশ্বে মাদক বা ড্রাগ ব্যবসাকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ড্রাগস এখন গোটা বিশ্বেরই একটি বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে। এ কথা সত্য যে, বিশ্বায়নের সুফল হিসেবে বিশ্বে মানবকল্যাণমুখী অগ্রগতি ও পরিবর্তন আসছে নানা ক্ষেত্রেই। এক দেশের ভালো জিনিসের ওপর অন্য দেশের অধিকার-ভোগ প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে দ্রুত। পাশাপাশি বিশ্বায়নের কুফল হিসেবে মানবজীবনের জন্য ক্ষতিকর কিছু উপাদান বিশ্বময় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এসবের মধ্যে মাদকদ্রব্য অন্যতম। পৃথিবীর ধনী ও গরিব প্রতিটি দেশে এবং খ্রীষ্টান-বৌদ্ধ-হিন্দু-মুসলমান সব ধর্মাবলম্বী মানুষের সমাজে, ছোট ও বড় শহরে মাদকাসক্তি একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে উঠেছে। গোটা বিশ্বে এক বছরে মাদক ব্যবসায় ৩২০ বিলিয়ন ডলার মুনাফা হয় বলে একটি গবেষণাগ্র্রন্থে উলেস্নখ করা হয়েছে। নরওয়ে দেশটি সাধারণত বিশ্বের মধ্যে মাথাপিছু আয়, স্বাস্থ্যসেবা, গড় আয়ু, শিক্ষা ইত্যাদি সূচকের বিচারে শীর্ষস্থান দখল করে থাকে। কিন্তু ইউরোপের মধ্যে এই দেশটিতেও মাদকাসক্তি গুরুতর সমস্যা বলে মনে করা হয়। বিশ্বায়নের বিভিন্ন অনুষঙ্গ, যেমন বাণিজ্য, যোগাযোগ, পর্যটন, মাইগ্রেশন, আর্থিক ও সাংস্কৃতিক লেনদেন ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে বিশ্ব মাদক সমস্যাটিও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বেসরকারিকরণের বিকাশ বিশ্বে এমনভাবে ঘটছে, এখন সব দেশের সরকারের পক্ষে বৈধ ও অবৈধ ব্যবসাকে আলাদাকরণ এবং নিয়ন্ত্রণ করাটাও কঠিন হয়ে পড়েছে। যেসব অস্থিতিশীল দেশে সরকার দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত, ক্ষমতাশালী মাদক ব্যবসায়ীরা সেসব দেশে তাদের নিয়ন্ত্রণ ও দাপট খুব সহজেই প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

 

 উপসংহার

আমাদের দেশ ও সমাজের মূল্যবোধের অবক্ষয় লক্ষ্য করে আমি আমার দুটো ছেলেমেয়ের উদ্দেশে একটি বইয়ের উৎসর্গপত্রে দেখেছিলাম: ‘তোমরা কৈশোরের সিঁড়ি বেয়ে আজ যৌবনে উঠে গেছো/বস্তুত তোমরা হারিয়েছো/তোমাদের শৈশব ও কৈশোর/অর্থাৎ তোমাদের নানা রঙের সেই দিনগুলি/ তোমাদের রুচি ও মেজাজে লেগেছে/ আজ নতুন প্রজন্মের হাওয়া/ তোমরা উল্টোদিকে নৌকোর বাদাম উড়িয়েছো। অনুপ্রেরিশক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দিকে। তোমাদের ‘নিজস্ব’ বলে কিছু থাকল না/বিদেশি সংস্কৃতির সর্বগ্রাসী প্রভাব/অতিক্রম করেই আজ তোমাদের/ সুন্দর করে বাঁচতে হবে/ মনে রেখো/সংস্কৃতিবিচ্যুত কোনো জাতি টেকে না/জাতও বাঁচে না/তাই সর্বাগ্রে চাই/ তোমাদের রুচি ও মনন ধারার পরিবর্তন/তোমরা ফিরে এসো। নিজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ঝুলন্ত বারান্দার দিকে/আকর্ষক গোলাপ বাগানের দিকে/অর্থাৎ মূল্যবোধের দিকে। আজ আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে সমাজের নানা বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। মানুষ অত্যাচারী ও জুলুমবাজ হয়েছে। অন্যায় করতে শিখেছে। অন্যায়কে ন্যায় বলে চালিয়ে দিচ্ছে। কারো প্রতি কোনো সহানুভূতি নেই। সমাজে ও রাষ্ট্রে সর্বত্রই আমরা একই চেহারা লক্ষ্য করছি। অবাক লাগে, মানুষ দুর্নীতিকে আজ দুর্নীতি মনে করে না। ন্যায়ের ম-ুপাত করছে। অন্যায়কে আঁকড়ে ধরছে। সুন্দর সমাজ গড়ার কথা ভুলে গিয়ে মানুষ অন্যায়ের সিংহদ্বার গড়ছে। এর মূলে রয়েছে মূল্যবোধের অবক্ষয়, অপসংস্কৃতির হাতছানি।


———————–


তথ্যসূত্র ও অন্যান্য

————————————–

·         আল-কোরআন, সূরা আন-নিসা, আয়াত-২৯, সূরা আল-জুমার, আয়াত-১০, সূরা আল-মুনাফিকুন, আয়াত – ৪

·        হাদিস শরীফ- মিশকাত, বুখারী, মুসলিম

·         সমাজ ও মূল্যেবাধ – ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়

·         শিক্ষা ও সামাজিক মূল্যবোধ – তসলিমা নাসরিন

·         সামাজিক বিজ্ঞান- নবম দশম শ্রেণী

·         মানবকল্যাণে ইসলামি অর্থনীতি – আবু হেনা মোস্তফা কামাল

·         প্রচারমাধ্যম, ভোগবাদ ও মূল্যবোধ – পারিজাত ভট্টাচার্য্য

·         দিক-ভ্রান্ত করার প্রয়াস

·         ইথিকস ক্লাব অব বাংলাদেশ এর ওয়েব সাইট

·         ইসলাম ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন

·         মূল্যবোধ আজ কোথায়? – সাইদ সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

·         সচেতন হতে হবে আমাদের- শওকত নূর

·         শিশুর খেলাঘর – ঈপ্সিতা চৌধুরী

·         কেউ ভোলে না কেউ ভোলে – সিরাজুল ইসলাম খান

·         অক্ষম, অসহায় পিতা-মাতা এবং বৃদ্ধাশ্রমের কাহিনী – কাজী এম ইউনুস

·         নারীর ক্ষমতায়ন ও ডিভোর্স – শাহানা আক্তার নূপুর

·         প্রতিবন্ধীরাও মানুষ : তাদেরও রয়েছে সমান অধিকার – মঈনুদ্দীন কাদের লাভলু

·         জাতীয় শিশু নীতি ২০১১

·         সমাজসেবায় ধর্মীয় মূল্যবোধ –  দিদার উল আলম

·         আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ধর্মীয় মূল্যবোধ অপরিহার্য -এসএম নজরুল ইসলাম

·         অন্তর্গত সৌন্দর্যের আলোয় – আবুল হাসনাৎ মিল্টন

·         মূল্যবোধ শিক্ষা প্রসঙ্গ – শামসুদ্দীন শিশির

·         মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি  – তিতাশ চৌধুরী

·         মানবিক মূল্যবোধ ও ইসলাম – মাওলানা সালেহ মতীন

·         সচেতনতা ও মূল্যবোধ – নজরুল ইসলাম টিপু

·         ইসলামে জ্ঞান, মূল্যবোধ ও কর্ম – ড. ইউসুফ আল কারজাভি

·         দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২২ আগষ্ট ২০০৮

·         দৈনিক সংবাদ – প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যা ২০১০

·         দৈনিক জনকন্ঠ – ২ সেপ্টেম্বর, ২০১০

·         দৈনিক ডেসটিনি, ২৯ এপ্রিল, ২০১০

·         হিস্ট্রী অব এনসিয়েন্ট বেঙ্গল – রমেশ চন্দ্র মজুমদার, কলকাতা

·         রাত যায় দিন আসে – আতিকুল হক চৌধুরী

·         http://www.shapludu.com

·         http://www.mukto-mona.com

·         http://www.bd-pratidin.com

·         http://bangla.irib.ir

·         http://www.shahriar.info

·         http://www.uttorpurbo.com

·         http://www.somewhereinblog.net

·         http://www.mathabhanga.com

·         http://www.islamshia-w.com

·         http://banglarkantha.com

·         http://bengali.cri.cn

·         http://www.shobdoneer.com

·         http://www.opest.net

·         http://www.amardeshonline.com

·         http://masumbd.tripod.com

·         http://www.somewhereinblog.net